পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৫

 ৮ই এপ্রিল ‘শাহীন’ এবং ‘ময়নামতি’ নামে দুটি পাকিস্তানী জাহাজ থেকে কয়েকজন বাঙ্গালী নাবিক পালিয়ে যান। তখন জাহাজগুলো বালটিমোরে অবস্থান করছিল। তাঁরা আমার সংগে যোগাযোগ করেন। এ সময় কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির জনাব গ্রিনোর সংগেও যোগাযোগ হয়। তিনি তাদের উদ্ধার করেন এবং উকিলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন যিনি তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন।

 ১৩ই এপ্রিল বি, বি, সি’র মাধ্যমে জাকারিয়া চৌধুরী ঘোষণা করেন যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ থেকে আমরা অনুভব করি যে আন্দোলন এবার নতুন পর্যায়ে শুরু হবে। জাকারিয়া চৌধুরীর সংগে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ হয় এবং তিনি দীর্ঘায়িত মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে উপদেশ দেন। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৬ই এপ্রিলে একটি সম্মেলনে আমি পাকিস্তানী প্রতিনিধি হিসেবে যাই এবং সেখানে তুরস্কের প্রতিনিধির সাথে আমার প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডা হয়। এই বাক-বিতণ্ডার বিষয় ছিল তুরস্ক কর্তৃক পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দান। এর তিনদিন পর আমাকে এই সম্মেলন থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং আমার চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এক কথায় আমাকে যতদূর সম্ভব অন্যদের সংগে যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমি তবুও আমার কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। আমি ১২টার সময় বের হয়ে যেতাম এবং প্রায় চারটার দিকে অফিসে ফিরতাম। এই সময়টুকুতে আমি আমার যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ চালিয়ে যেতাম।

 ২৭শে এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেণ্ট ম্যাকনামার সংগে আমার যোগাযোগ হয়। আমি পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের জন্য আবেদন জানাই। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহকারী পরিচালক গ্রেগরি ভোটার সংগে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে থাকি। তিনি বাংলাদেশের বিষয়টি দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া ইউ এস এইডের মিঃ ডন ম্যকডোনাল্ড-এর সংগেও যোগাযোগ অব্যাহত থাকে।

 ১৩ই এপ্রিল দূতাবাসের কর্মচারী এবং আরো কয়েকজন চাঁদা তুলে হারুন রশীদকে কলকাতায় পাঠান সংবাদ সংগ্রহ এবং সঠিক অবস্থা জানতে। হারুনুর রশীদ বিশ্বব্যাংকে চাকুরী করতেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনে অগ্রপথিকের ভুমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতা গিয়ে মুজিব নগর সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন-এর সাথেও দেখা করেন। তিনি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। ফিরে এসে তিনি খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদ দিতে পারেননি। তিনি জানান যে, অবস্থা এখনো পরিষ্কার নয় এবং আন্দোলন ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে না। এ সময় আমেরিকান সোসাইটি ফর এণ্টারন্যাশনাল ‘ল’-এর বার্ষিক অধিবেশনে প্রফেসর গাটলিয়ের ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মান অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। এই সম্মেলনে আমি যোগ দিই কিন্তু দুতাবাস অন্য একজন পাকিস্তানীকে প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করে। এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখে নিউইয়র্ক দূতাবাস থেকে জনাব মাহমুদ আলী বাংলাদেশের পক্ষে তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এমনিতেই তাঁর প্রতি পাকিস্তানী সরকার প্রসন্ন ছিলেন না যেহেতু তিনি সে বছর জাঁকজমকের সাথে একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করেছিলেন। পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী সেই থেকে তাঁর পেছনে লেগেই ছিল।

 মে মাসের প্রথম পক্ষেই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ৯ই মে জনাব এম এম আহমেদ ওয়াশিংটন পৌঁছেন। ১১ই মে পাকিস্তান সমস্যার ওপর কংগ্রেসে “গ্যালাগার শুনানী“শুরু হয়। ১২ই মে জনাব রেহমান সোবাহান একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং সেটি অত্যন্ত সফল হয়। এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর জনমত আমাদের আন্দোলনের পক্ষে আরো তীব্র হয়ে উঠে এবং প্রচুর প্রচার হয়। একই সময় দূতাবাসের সহকারী শিক্ষা অফিসার জনাব এ আর খান গ্যালাগার শুনানীতে উপস্থিত থাকার জন্য চাকুরীচ্যুত হন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে “বাংলাদেশ লবী’ সংগঠিত ও জোরদার হয়ে উঠে। বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে চাপ প্রয়োগ আরো তীব্র এবং ফলপ্রসূ হতে থাকে। এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল একটিই। তাহল পাকিস্তানকে প্রদত্ত সামরিক এবং অন্যান্য সাহায্য বন্ধ করা।