পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৮

হুকুম মত বিভিন্ন লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন আর সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লিখেন। জনাব হামিদুল হক চৌধুরীকে খুন খারাবীর বিবরণ দিতে বেশ বস্তুনিষ্ঠ বলেই মনে হলো। তিনি বললেন যে বিহারীরা বাঙ্গালীদের খুব মেরেছে আর সেনাবাহিনী জুলুম করেছে। সব পরিবারেই কিছু না কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা প্রাণ হারিয়েছে। যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেটা সারতে অনেক দিন লাগবে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে ভাব করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। কিছুদিন হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। তার মূল কথা ছিল, দোষ যারই হোক, ভারতের সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমানের বন্ধুত্ব হতে পারে না। আমি যখন তাকে বললাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে আর কিছুদিন পরে সেখানে আমরা ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে পারবো। তখন তিনি রাগের সঙ্গেই বললেন “তোমাদের বাংলাদেশে আমাকে পাবে না।” আমি হেসে বললাম, “আমরা তাহলে জেনেভায় বসেই বিগত দিনের স্মৃতি আলোচনা করবো।“হক সাহেব অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিশ্বব্যাংক বিশেষভাবে কি করতে পারে, কি উপদেশ তিনি এ ব্যাপারে মিঃ ম্যাকনামারকে দিতে পারেন। দূতাবাস তাকে নানা কাজ করতে বলে ও তার জন্য চিঠিপত্র তৈরী করে দেয়। কিন্তু তিনি তার নিজের ইচ্ছায়, নিজের ঢং-এ পাকিস্তানের প্রচারকার্য করেন।

 বাঙ্গালী কূটনীতিক জনাব এস এ করিম দূতাবাসের কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। তিনি নিউইয়র্ক পাকিস্তান মিশনের দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন এবং মার্কিন মুল্লুক যত বাঙ্গালী কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি প্রথম থেকেই আমাদের সংগে সব সময় যোগাযোগ বজায় রাখতেন। তিনি আফ্রিকা সফর শেষ করে ওয়াশিংটনে আসেন। তিনি এসে তার সহকর্মীদের বুঝালেন যে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার আর কোন যৌক্তিকতা নেই আর বাংলাদেশ সরকারের ডাকে সাড়া দিতে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তিনি বলিষ্ঠভাবে একে একে সব কর্মকর্তাদের সংগে আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। সর্বশেসে সমস্যা হলো অসুস্থ জনাব এনায়েত করিমকে নিয়ে। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন এবং তার চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাঁর এই অবস্থা তার সহকর্মীদের মনে দুর্বলতা এনে দেয়। পরিশেষে ঠিক হলো যে করিম দম্পতির সংগে সরাসরি আলাপ করাই ভাল। কিন্তু বেগম করিম এবং জনাব এনায়েত করিম উভয়ে অত্যন্ত সাহস দেখান। জনাব করিম যে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন “আমি আপনাদেরই সাথে আছি।“

 ৩রা আগষ্ট মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জনাব মাহবুব আলম চাষী ও তার সহকারী তৈয়ব মাহতাবের সাথে আমার কথা হয় এছাড়া বিচারপতি চৌধুরীর সাথেও আমি যোগাযোগ করি। ৪ঠা আগষ্ট এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করি আমি এবং ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকার ন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের সম্পাদক রোনাল্ড কোভেন এতে আমাকে সহযোগিতা করেন। তিনিও নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেনজামিন ওয়েলসকে একদিন আগে আমি জানিয়ে দিই যে সম্মেলনে আমার সব বন্ধু তাদের আনুগত্য পরিবর্তন ঘোষণা করবেন। একই সময় প্রেসিডেণ্ট নিকসন-এর একটি প্রেস কনফারেন্স হচ্ছিল যার ফলে আমাদের আনুগত্য প্রকাশের সংবাদ ততটা ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি। তবে এই সাংবাদিক সম্মেলনে নিকসন বলেন যে আমেরিকা সব সময় “পশ্চিম পাকিস্তানের“পাশে থাকবে। তাঁর এই বিশেষ শব্দ ব্যবহার সবারই কানে লাগে এবং এটি ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ৫ই আগষ্ট জনাব এম, আর সিদ্দিকী আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আগমন করেন। ৩রা আগষ্ট গ্যালাগার সংশোধনী পাস হয়। যদিও সিনেটে এর ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিশ্চিত ছিল না তবুও এটি ছিল একটি বিরাট বিজয়। ১৯শে আগষ্ট টরনটোতে অক্সফ্যাম আয়োজিত একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্যার হিউ কিননীসাইত এতে সভাপতিত্ব করেন আর বৃটেনের জুডিথ হার্ট, ভারতের জেনারেল চৌধুরী, প্রফেসর নূরুল হাসান এবং কানাডায় বহু সংসদ সদস্য এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো সুবিখ্যাত “টরনটো ডিকলারেশন” হিসেবে পরিচিত। এই সম্মেলনে জনাব এম আর সিদ্দিকী ও আমি বাংলাদেশের তরফ থেকে উপস্থিত ছিলাম।