পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৪১

অভিযোগ শোনা হয় এবং সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং কয়েকশত বন্দীকে গুলি করে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়।

 আমরা পাকিস্তানী প্রশাসনযন্ত্রকে বিকল করে দিয়েছি, জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম এবং যুদ্ধের মনোভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি এবং এর ফলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে, বিদ্রোহের প্রথম স্তর সম্পূর্ণ হয়েছে, এখন জনগণের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ। আমি সরকারী কর্মচারীদের ছয় মাসের বেতন দিয়ে বলি যে, অফিসে তারা যেন আর ফিরে না আসে। সক্ষম যোদ্ধাদের বলি সীমান্তের দিকে চলে যেতে যেহেতু নড়াইলকে আর রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এরপর আমি নড়াইল ত্যাগ করি। আমার ইচ্ছা ছিল বাবা-মার সাথে শেষবারের জন্য একবার দেখা করা এবং সে উদ্দেশ্যেই আমি এপ্রিল মাসের ৭/৮ তারিখে ঢাকায় আসি। ঢাকায় আমাদের বাসার দিকে যখন রওয়ানা হচ্ছি তখনই আমার একজন পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে জানান যে, নড়াইলের সব ঘটনার খবরই ঢাকায় এসে পৌঁছে গেছে। সেনাবাহিনী জানে আমি বহু পাকিস্তানী হত্যা করেছি। যদি বাসায় যাই, আমাকে তো ধরে হত্যা করা হবেই, বাবা-মাও আর বাঁচবে না। একথা শোনার পর আমি স্কুটার নিয়ে নয়ারহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই এবং রাজবাড়ী হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে যেতে থাকি। পথের মধ্যে লক্ষ্য করি সব জায়গাতেই বিহারীরা অত্যন্ত তৎপর। চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে যখন নৌকা করে যাচ্ছি তখন একটি বিমান এসে নৌকার ওপর গুলি ছোড়ে। আমি পানিতে লাফ দিয়ে জীবন রক্ষা করি এবং শেষে কলকাতায় পৌঁছি।

 কলকাতায় গিয়ে কীড ষ্ট্রীটে সমবেত হই। এখানে বহু এমপির সাথে দেখা হয় এবং ১৭ই এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথাও জানতে পারি। এর পরে পাকিস্তানী দূতাবাসের জনাব হোসেন আলী এবং আনোয়ার করিম চৌধুরীর সাথে দেখা করি এবং সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিই। তাদের বক্তব্যও আমি শুনি। তবে আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতায় আমার অবস্থানের কোন প্রয়োজন নেই, এবং আমি তখন খুলনা সীমান্তের গজাডাংগা ক্যাম্পে যোগদান করি। এই ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন।

 মে এবং জুন মাস ট্রেনিং এবং ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনার মধ্যে কাটে। জুন মাসের শেষে জেনারেল ওসমানী এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন এবং আমার খোঁজ করেন। তিনি আমাকে বলেন যে, মুজিব নগর সচিবালয়ে আমার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমার প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও করার কিছু ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন সর্বাধিনায়ক। আমি কলকাতায় ফিরে আসি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে সাধারণ প্রশাসন বিভাগের সচিব জনাব নূরুল কাদের খানের সংগে দেখা করতে বলেন। তিনি আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব যোগদান করতে আদেশ দেন।

 পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব খন্দকার মোশতাকের সাথে এর পূর্বে আমার কোন আলাপ ছিল না। যাই হোক তাঁর সঙ্গে আমি কাজ করতে শুরু করি। আমার প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এছাড়া যারা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করতে চাইতেন তাঁদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া এবং বিভিন্ন আদেশ পৌঁছিয়ে দেয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে যে সকল আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব দেখা করতে আসতেন তাঁদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেয়াও আমার কাজের অংশ ছিল। যেহেতু খন্দকার মোশতাক সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন সেহেতু সংসদ সদস্যদের বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং বিভিন্ন সংসদীয় উপদল এবং গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও আমার দায়িত্বের মধ্যেই এসে পড়ে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের দিকে খন্দকার মোশতাক মুজিব নগর সরকারের ভেতর কোণঠাসা হয়ে পরেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ছিল যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। অতএব, যদিও জাতিসংঘ প্রেরিত প্রতিনিধিদলে তাঁর নেতৃত্ব করার কথা ছিল কিন্তু তাঁকে বাদ দেয়া হয় এবং তাঁর স্থলে দলের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়োগ করা হয়।