পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড
১৯৭

 মুজিবনগর সরকারের কাজ ছিল প্রধানত দুটি-এক. যুদ্ধ করা, দুই, শরণার্থীদের দেখাশোনা করা। আমাদের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানত ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলো ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে।

 আমরা মাঝে মাঝেই এই শরণার্থী শিবিরগুলোতে যেতাম। সেখানকার অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এত মানুষকে এত কষ্টে জীবনযাপন করতে আমি দেখিনি। তবে ভারতীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এই দুরবস্থা কিছুটা লাঘব করার জন্য বহু কাজ করেছে।

 সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল মুক্তিফৌজ গড়ে তোলা। ছেলেদের প্রশিক্ষণ দান ছিল এই কর্মসূচীর প্রধান অংশ। এই লক্ষ্যে “যুব নিয়ন্ত্রণ বোর্ড” গঠিত হয়। উইং কমাণ্ডার মীর্জা এর প্রধান ছিলেন। ফ্লাইট লেঃ রেজা তাঁকে সহায়তা করতেন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ তরুণ ও যুবক এসে তাতে যোগদান করে। এই যুবশিবিরগুলোকে মুজিবনগর সরকারের অর্থে চালানো হতো। শিবির এলাকা থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হতো কিন্তু সব খরব ‘ফাইনানসিয়াল রুল' অনুযায়ী হতো। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার যে নিয়মে তার টাকা বরাদ্দ ও খরচ করে, আমরা যতদূর সম্ভব, সেইভাবেই করতাম। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারী কর্মচারীদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল পাঁচশত টাকা। যুদ্ধের খরচের ব্যাপারে সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতেন মন্ত্রী পরিষদ। এটি আমাদের বিষয় ছিল না।

 জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আঞ্চলিক প্রশাসনিক এলাকাগুলো যেমন সেই এলাকার সব দায়িত্ব বহন করতো তেমনি এদের প্রায় সামগ্রিক অর্থ যোগানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের বিভাগের। তবে আমরা খুব টেনে খরচ করতাম যেহেতু আমাদের অর্থ ছিল কম এবং কেউই বলতে পারতো না যুদ্ধ কতদিন চলবে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাদের সব হিসাবের সঠিক হিসাব গ্রহণ করে।

 কিছু কিছু মুক্ত এলাকায় সীমিতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করা হয়েছিল। এর একটি কারণ ছিল শত্রুকে জানানো যে আমরা ক্রমে প্রশাসন দখল করে নিচ্ছি। এছাড়া বেসরকারী কোন সংগঠন বা কোন দলের হাতে ক্ষমতা যাতে না যায় সে জন্যও। এই সব কাজেও আমাদের দপ্তর সাহায্য করতো ও নিয়ন্ত্রণ রাখতো।

 মুজিবনগর সরকার একটি প্লানিং বোর্ড স্থাপন করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে বলা যেতে পারে আগামী বাংলাদেশের একটি প্রতিবিম্ব স্বরূপ। যে সব পরিকল্পনা এখানে তৈরী হয় তা ছিল সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলক। বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা তৈরী হয় বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই পরিকল্পনাগুলো ছিল স্বাধীন দেশের জন্য-সেই স্বাধীনতা যত দ্রুতই আসুক বা দীর্ঘকাল পরেই আসুক।

 অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা যেতে পারে। জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলগুলোকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়া হতো অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে। একই সাথে এটাও লক্ষ্য করা তাদের দায়িত্ব ছিল যে অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যেন চাঁদা সংগ্রহ অভিযান না চালায়। কেবলমাত্র তাদের চাঁদা সংগ্রহই বৈধ ছিল এবং তারাই সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করবেন।

 তবে আমরা এটাও জানতাম যে বিচ্ছিন্ন যেসব মুক্তি এলাকা ছিল বা যেখানে যোদ্ধারা ছিল সেখানে চাঁদা ওঠানো হবে। আমরা খবর পেতাম যে চাঁদা সংগ্রহ হতো খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। সাধারণ মানুষরা এই সব ক্ষেত্রে নিজেরাই এগিয়ে এসেছে সব ধরনের সাহায্য নিয়ে। জোনার এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল-এর ব্যাপারে আর একটা বলা যায়। সেটা হচ্ছে এই বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হতো তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য। কেননা এই ব্যবস্থা ছাড়া তদের পক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করা সম্ভব ছিল না। প্রায় সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তাদের ছিল। আমরা মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করতাম সম্পূর্ণ নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর। আমাদের সংগে ভারতীয় সরকারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক এবং প্রয়োজনভিত্তিক।