পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
 ২০২

১৯৭১ সনের মে মাসের শেষের দিক। মুজিবনগর সচিবালয় থেকে একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্রাম এলো আমার নামে, বায়োডাটায় দেয়া কৃষ্ণনগরের ঠিকানায়। আমাকে অতি শীঘ্র সচিবালয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। সেই মতে পরদিনই কলকাতায় চলে আসলাম। ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থিত মুজিবনগর সচিবালয়। সেখানে গিয়ে দেখি তৎকালীন সচিবালয়ের সচিব জনাব নূরুল কাদের খান আগরতলায় ট্যুরে গেছেন এবং তাঁর অবর্তমানে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র (ইণ্টিরিয়ার) সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান সাহেব সংস্থাপন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর নিকট থেকে জানলাম তৎকালীন মন্ত্রীবর্গের ক্যাবিনেট মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের কথা। আমার মতামত পেলে তাঁরা আমাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগদান করবেন। আমি এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে, সানন্দে মত দান করলাম। কয়েকদিন পর, ভারতীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে এবং সমগ্র রিলিফ অপারেশন প্রত্যক্ষভাবে দেখাশুনার সুবিধার্থে পদটিকে সচিব হিসেবে আখ্যায়িত না করে রিলিফ কমিশনার হিসেবে নিয়োগদান করেন। ফলে রিলিফ কমিশনারকে একদিকে যেমন সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হতো, অন্যদিকে আবার রিলিফ অপারেশনের দিকটাও দেখতে হতো।

 পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ভারতে। এই এক কোটি জনগোষ্ঠীর ত্রাণকার্য পরিচালনা করা সহজসাধ্য নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় এই লোকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে খাদ্য বস্ত্র কম্বল প্রভৃতি ত্রাণ সামগ্রী এসেছে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রিলিফ কমিশনার হিসেবে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল ভারত সরকারের সাথে সংযোগ রক্ষা করা এবং ত্রাণ সামগ্রী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে যাতে যথাযথভাবে পৌঁছে যায় এবং তা সুষ্ঠুভাবে বণ্টিত হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখা। এ ব্যাপারে আমাকে বিভিন্ন ক্যাম্প (শিবির) পরিদর্শন করতে হয়েছে। তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত উদ্ভূত সমস্যাবলী নিয়ে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বৈঠকে বসতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সচিব মিঃ কলহান ও অতিরিক্ত সচিব মিঃ লুথরা-র নাম উল্লেখ করতে চাই।

 অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় শরণার্থীকে তাৎক্ষণিক বিপদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তৎকালীন বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামানের পরামর্শক্রমে কিছু কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়েছে।

 জনাব মো: হোসেন আলী সাহেব ছিলেন তৎকালীন কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার। তিনিই সর্বপ্রথম পাকিস্তান দূতাবাস কর্মীদের মধ্যে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং তিনিই বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার হিসেবে কলকাতায় নিয়োজিত হন।

 প্রথম অবস্থায় তাঁরই সহায়তায় মুবিজনগর সচিবালয়ের পত্তন হয় কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে। অল্প কিছুদিন পরই সচিবালয়টি স্থানান্তরিত করা হয় ৮নং থিয়েটার রোডের একটা বড় বাড়িতে। প্রধানত এখান থেকেই মুজিবনগর সচিবালয়ের কাজ পরিচারিত হতো। এখানেই বসতেন তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী সৈয়দ মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ত্রাণ, পুনর্বাসন ও স্বরাষ্ট্র (ইণ্টিরিয়ার) মন্ত্রী এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান সাহেব। শেষ পর্যায়ে সচিবালয়ের কর্মচারীর সংখ্যা বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলানের জন্য সচিবালয়ের অধিকাংশ বিভাগ স্থানান্তরিত করা হয় বালিগঞ্জ এলাকায় শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় রোডে একটি বড় বাড়ীতে।

 মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর সন্তানদের প্রতিদিনের কৃতিত্বের কথা আমাদের সচিবালয়ে নিয়মিত সরবরাহ করা হতো। মাঝে মাঝেই ক্যাবিনেট মিটিং বসতো এবং মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আমরা পর্যালোচনায় বসতাম। এদিকে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় তাজউদ্দিন আহমদ এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি স্বর্গীয় সৈয়দ নজরুল