পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২১৫

 এ ছিল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। কিন্তু এটা করেই আমরা বসে থাকিনি। আমাদের পার্টি বেআইনী এবং আত্মগোপনে ছিল। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক প্রভৃতি গণসংগঠনের মাধ্যমে এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আমাদের যতটুকু যোগাযোগ এবং সম্পর্ক ছিল তা কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রচারকার্য চালিয়েছি। পার্টির নামোল্লেখ না করে আমরা ‘একতা’ নামে যে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সুযোগ গ্রহণ করেছিলাম তার মাধ্যমেও আমরা দেশপ্রেমিক শক্তি ও জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য প্রচার চালিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে আমরা সম্ভাব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাধ্যমতো আমাদের পার্টি ও জনগণকে প্রস্তুত করে তুলিছিলাম।

 ১লা মার্চের পর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসমাবেশ থেকে “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম” বলে ঘোষণা দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন, আমরা তার পুরোপুরি সমর্থক ছিলাম। ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তখন আলোচনার বিরোধিতা করাকে আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করিনি, কিন্তু আমাদের পার্টির মুল্যায়ন ছিল যে ঐ আলোচনায় কোনো অপসরফা হবে না, কেননা জনগণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছে এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদীরা এটা মেনে নিতে পারে না। আমাদের পার্টি তখন জনগণের সচেতনতা জাগরুক রাখার জন্য এবং আসন্ন যেকোনো ধরনের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে ঢাকাসহ সম্ভব মতো দেশের সব জায়গায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, তাদের কুচকাওয়াজ ও ট্রেনিং ইত্যাদির ব্যবস্থা করি। তখন ছাত্রসমাজের শক্তিশালী প্রগতিশীল সংগঠন “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন” আমাদের পার্টির প্রভাব থাকায় তাদের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউ ও টি সি’র সহায়তায় তরুণ-তরুণীদের রাইফেল ট্রেনিং এবং কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। ডেমরা এলাকার কিছুসংখ্যক শ্রমিককেও আমরা স্বেচ্ছাসেবক করে এ-ধরনের ট্রেনিং-এ যুক্ত করেছিলাম। এ-সব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ ও তাদের মনোবল বৃদ্ধি করা এবং সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে মানসিকভাবে সচেতন ও প্রস্তুত করে তোলা। এক কথায় ঐ সময়টাতে আমাদের পার্টির ভূমিকা ছিল অবশ্যম্ভাবী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাধ্যমতো সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ, জনগণকে সচেতন ও প্রস্তুত করে তোলা। আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ২৫শে মার্চের আগেই বুঝতে পেরেছিল যে অবস্থা ক্রমেই সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ করা যায় যে, ৯ই মার্চ ঢাকায় উপস্থিত কেন্দ্রী কমিটির সদস্যদের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের যথাসম্ভব প্রস্তুতির জন্য একটি সার্কুলার প্রচার করা হয়েছিল। তবে তখনকার পরিস্থিতিতে কোনো কোনো জেলায় সার্কুলারটি বিলম্বে পৌছে এবং পার্টির তখনকার শক্তিসামর্থ্য সম্রস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতিতে কোনো কোনো জেলায় সার্কুলারটি বিলম্বে পৌঁছে এবং পার্টির তখনকার শক্তিসামর্থ্য সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপক প্রস্তুতির উপযুক্তও ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে ২৫শে মার্চ জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়।

 সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল এই যে জনগণ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছে এবং বিশেষত সমগ্র পাকিস্তানে আওয়াম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং বাঙ্গালীদের জাতীয় অধিকারের দাবির সঙ্গে ১১-দফায় সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হওয়ায় পাকিস্তানে একটা সরকার গঠন এবং বাঙালীদের দ্বারা শাসিত হওয়ার অবস্থা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই মেনে নেবে না। কাজেই বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য এবং তা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাবে। সে জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত করাই মুখ্য কাজ এবং তা খুব দ্রুত করতে হবে।

 সামগ্রিক অবস্থা মুল্যায়নের আরও একটি দিক আমাদের পার্টির ছিল। তা হচ্ছে; আমরা সচেতন ছিলাম যে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কতকগুলি দুর্বলতা থাকবে। মধ্যস্তরের জনগণের যে দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও তার বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চেতনার ঘাটতি ছিল। এবং শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের সংগঠন শক্তি ছিল দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আমরা