পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২১৬

অনিবার্য ঘটনা-ধারায় পিছনে না থেকে সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগ্রামের গতিধারায় অন্যান্য দেশপ্রেমিক শক্তি ও জনগণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাদের সচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ঐ দুর্বলতাগুলো কাটানো প্রয়োজন বলেই তখন সিদ্ধান্ত করেছিলাম। তাছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের জন্য জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় মুক্তির সমর্থক আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সমর্থন সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তাও আমরা উপলব্ধি করেছিলাম। উল্লেখ্য যে, ২৫শে মার্চের আগেই ঢাকায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পত্র পাঠায়।

 স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করা ও প্রচার চালানোর মাধ্যমে প্রতিরোধের শক্তিগুলোকে প্রস্তুত করার চেষ্টার কথা আগেই বলেছি। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হলে আমাদের পার্টির ছাত্র-যুবক-শ্রমিকস্বেচ্ছাসেবকরা যেখানে যতটুকু সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ প্রভৃতি দেশপ্রেমিক শক্তির সঙ্গে মিলিতভাবে প্রতিরোধরত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর বাহিনীর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ এই প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে প্রথমে শহর থেকে গ্রামে এবং পরে বাধ্য হয়ে আমাদের কর্মীরা ভারতে চলে যায়। তাঁরা আমাদের পার্টি ও গণসংগঠনের সমর্থক ও ইচ্ছুক তরুণদেরও সংগঠতি করে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এর জন্য ভারত যেতে থাকেন। অনেক বিপন্ন পরিবারও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

 সীমান্ত অতিক্রম করার প্রাক্কালে আমি রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলাম। বাইরে সমগ্র জাতি যে মুক্তির জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম সামনে অপেক্ষা করছে এক নিদারুণ রক্তাক্ত সংগ্রাম। রাজশাহী শহইে ই পি আর-এর ক্যাম্প ছিল। পাকবাহিনীর ক্যাম্পও ছিল। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী ই পি আর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ই পি আর প্রতিরোধ করে। আমি গোলাগুলির আওয়াজ শুনি এবং কিছু কিছু গোলাগুলি জেলখানার কাছে এসে পড়তে থাকে। ফলে বন্দীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। গোলাগুলির মাঝ পড়ে বন্দী অবস্থায় মৃত্যু ঘটতে পারে। অন্য সকল আমাকে এসে বলে যে আপনি ডি আই জি-কে বলুন জেলের গেট কুলে সকলকে মুক্তি করে দিতে। ডি আই জি কে বললাম, কিন্তু রাজি হন না। তখন বন্দীরা সিদ্ধান্ত নেয় জেল ভেঙ্গে বের হবে। বাইরে জনতাও জেলা ভাঙ্গা সমর্থন করে। বন্দী ও জনতা মিলে জেলের ময়লা ফেলার দরজা ভেঙ্গে ফেলে। আমরা বের হয়ে আসি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। জনতাই আমাদের পদ্মা নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে নৌকায় উঠিয়ে দেয় এবং বলে যে, শহরে থাকা আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়, আপনারা নদীর ওপারে চলে যান। নৌকাযোগে নদী পার হয়ে বুঝতে পারি যে, আমরা ভারতের মাটিতে পা দিয়েছি। কারণ পদ্মার ওপারেই ভারত।

 এই সময়ে জেলের ভেতরের বিচিত্র কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মার্চ মাসের একটি অসাধারণ ঘটনা চিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে 'স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলে ডাক দেয়ার পর ঐ ভাষণ ও ঘোষণার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন ও সমর্থন জানিয়ে রাজশাহী জেল থেকে একটি টেলিগ্রাম করতে চাই। জেল কর্তৃপক্ষ বলেন যে, “আপনি তো টেলিগ্রাম করতে পারবেন না, কারণ আপনি ডেটিনিউ। আপনার টেলিগ্রাম পাঠাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুমোদন লাগবে।” আমি বললাম, “তবে অনুমোদন নিয়ে আসুন”। তাঁরা বললে যে, “এখন অনুমোদন আনা যাবে না, কারণ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে কেউ কাজ করছে না, তারা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।” পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও অসহযোগ আন্দোলনে শরীক হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা আমার রাজনৈতিক জীবনে ইতপূির্বে আর ছিল না। তখন জেলের ভেতর থেকে আমি বুঝতে পারি যে সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য কতখানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

 প্রতিরোধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে আমাদের আত্মগোপনরত পার্টির সম্পর্ক ছিল। বিশেষত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফ্ফর) আমাদের পার্টির ঐতিহ্যগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ন্যাপের অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক ভূমিকার জন্য আমাদের পার্টির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ও নীতিগত মিল ছিল বেশী। অসহযোগ আন্দোল, প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন