পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২২১

 ছিলাম যে, আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল শক্তিসমূহ, বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন ও সাহায্য ব্যতীত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট বর্বর ইয়াহিয়া চক্রকে পরাভূত করা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই পার্টি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন ও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে দুনিয়ার ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাছে বিশদ চিঠি পাঠানোর এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দুনিয়ার সমস্ত প্রগতিশীল জনমত সমবেত করার জন্য ও অন্য সকল সম্ভাব্য পন্থার জন্য চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত মতে প্রথমে পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার আগে ১৪ই মার্চ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরে মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিসহ দুনিয়ার প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। আমাদের পার্টির সে চিঠি হতেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও দুনিয়ার বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের মাধ্যমে জাতিসমূহের স্বাধীনতা ও মুক্তি সমর্থনকারী শান্তি ও প্রগতির শক্তিসমূহ এবং গণতান্ত্রিক জনগণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেয়েছিল। এটি বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠায় ও আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রচারে সহায়ক হয়েছিল।

 কোচিনে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে কংগ্রেসের কথা আগে বলেছি সেখানে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিদল ২২টি ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। তাছাড়া শান্তি আন্দোলন ও অন্যান্য প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন পাবার চেষ্টা আমাদের পার্টি করেছে। আমরা বলতে পারি যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে সমবেত করার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টি যথোচিত উগ্যোগ গ্রহন করেছিল এবং এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে যথাসাধ্য অবদান রেখেছে। বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এবং তার কার্যকর ভূমিকা সংহত করার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টির অবদানই সবচেয়ে বেশি।

 স্বাধীনতাযুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত ছিল সমগ্র জাতির একতা এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে স্বাধীনতার সকল শক্তি বিশেষত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যবদ্ধ কর্মতৎপরতার প্রয়োজন ছিল। আমাদের পার্টি স্পষ্টভাবে এইসব রাজনৈতিক দল সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রণ্ট গঠনের আওয়াজ তুলেছিল এবং সে ফ্রণ্ট গঠনে অবিরাম প্রচেষ্টা নিয়েছিল। বিশ্ব জন্মত এবং ভারতের জনমতও বাংলাদেশের নিকট এরূপ জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ এ-ধরনের জাতীয় ঐক্য গঠনের গরুত্ব বিলম্বে উপলব্ধি করে। পাশাপাশি কয়েকটি মাওবাদী উপদল আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে তথাকথিত “বামপন্থী ফ্রণ্টের” নামে এক বিভেদাত্মক আওয়াজ তুলেছিল। এই দুই মনোভাবের বিরুদ্ধেই আমাদের পার্টির ঐক্যের নীতি তথা জাতীয় মুক্তিফ্রণ্টে গঠনের নীতি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে কার্যকর হয় নি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকাল পরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রতিনিধি এবং ব্যক্তিগতভাবে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তদানীন্তন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একটি “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠিত হয়েছিল। এই কমিটিতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধি ছিলাম আমি।

 এই পরামর্শদাতা কমিটি গঠনের গরুত্ব ছিল এই যে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তি যে একতাবদ্ধ সেটা প্রত্যক্ষভাবে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করা গিয়েছিল। বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে ঐ কমিটি দেশের ভেতরে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন উৎসাহউদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। ঐ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশপ্রেমিক শক্তির আরও সমঝোতা ও ঐক্য গড়ার ভিত্তিও সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের পার্টি “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে ঐ কমিটি তেমন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি এবং ঐ ঐক্যের উচ্চতর কোনো বিকাশও ঘটেনি। এ বিষয়ে প্রধানত গুরুত্ব উপলব্ধিতে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা ও অনুৎসাহ ছিল।