পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৫

বক্স বেজেঞ্জো, খায়ের বক্স মারী, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গলসহ বেশ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী এমএনএ এ কথা স্পষ্ট করে আমার কাছে বলেছেন যে, ইনসাফ কায়েম করতে না পারলে চিরদিনের জন্য একটা জাতিকে এভাবে রাখা সম্ভব নয়।

 এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে শেখ মুজিব যখন ঢাকা সেনানিবাসে আটক, আমরা কয়েকজন প্রত্যেকদিন তার সাথে দেখা করতে যেতাম। অফিসারস মেসে দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হত। কর্নেল এ,বি, নাসেরের ওপরে দায়িত্ব ছিল আমাদের মেহমানদারীর। সেখানে প্রায় দিনই নাসেরও আলোচনায় অংশগ্রহণ করত। শেখ সাহেব বলতেন, নাসের, দেখো, মামলায় আমার কি হবে আমি জানি না কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলছি। দেশের দুই অংশের সম্পর্কটাকে তোমরা এত বেশি নাজুক করে তুলেছো যে যত বেশি টানবে তত শীঘ্র ছিঁড়ে যাবার থাকবে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকে আওয়ামী লীগ পার্লামেণ্টারী পার্টির নির্বাচনে আমি পার্টির চীফ হুইপ হই। অন্য দুইজন ছিলেন জনাব আব্দুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম। ৩রা মার্চ থেকে পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে। স্বভাবতই চীফ হুইপ হিসেবে পরিষদ ভবনে সংসদ সদস্যগণের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আমি খুই ব্যস্ত। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু সংসদ সদস্য ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে নেতা আমাকে তার ৩২ নং রোডের বাসায় ডেকে পাঠালেন। ঐ বাসায় সব সময় লোকজনের অসম্ভব ভীড়, আমি এলেই গাজী গোলাম মোস্তফা আমাকে বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরী রুমে পৌঁছে দিলেন। সেখানে দরজা বন্ধ রেখে বঙ্গবন্ধু আরেকজনের সাথে নীচুস্বরে আলাপ করছিলেন। আমি ঢুকতেই তিনি গাজী সাহেবকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতে বললেন। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হলেন আলী সাহেব, কোলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার। তাঁদের মধ্যে যা আলোচনা হবার তা পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। তিনি সালাম জানিয়ে চলে গেলে নেতা আমাকে বললেন, বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ আলোচনা করে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ওরা সবকিছু সহজভাবে এগিয়ে যেতে দিবে না। হয়তো একটা চরম পরিণতির দিকেই আমরা অনিবার্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই জন্যেই আমি হোসেন আলী সাহেবকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। যদি সে রকম একটা অবস্থার উদ্ভব হয়, তার চিন্তাভাবনা এবং ব্যবস্থা তো আগে থেকে কিছু করে রাখতে হবে। তারপর তিনি আমাকে অন্যান্য প্রস্তুতি কতদূর কি হলো জানতে চাইলে আমি তাকে গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করলাম।

 ২৪ শে মার্চ সকাল ৬টা। বাসার টেলিফোন বেজে উঠলো। দিনাজপুর সদর এসডিও আবদুল লতিফ সাহেব অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে জানালেন সৈয়দপুরে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। বাঙালীদের মেরে শেষ করে দিচ্ছে।

 এর কয়েকদিন আগে থেকেই গোটা দেশে একটা থমথমে ভাব। একদিকে আইন অমান্য আন্দোলন, অন্যদিকে আলোচনা চলছিল বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়া খাঁর মধ্যে। উত্তেজিত ফেটে পড়েছে সারাদেশ। এর মধ্যে হঠাৎ সৈয়দপুরে বাঙালী- বিহারীদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে তা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যকে আরো দূরে ঠেলে দেবে। আমি ফোন করলাম জিলা আনসার কমাণ্ডার শরীফুল ইসলাম সাহেবকে। তাকে বললাম রাইফেল ক্লাবে কি কি অস্ত্র এবং গুলি আছে খুব তাড়াতাড়ি বের করে আনুন। বেশ কয়েকটি রাইফেল এবং কয়েক কার্টন গুলি নিয়ে এসডিও সাহেবের জিপে এগিয়ে চললাম সৈয়দপুরের দিকে। সৈয়দপুরের কাছাকাছি যাওয়ার পর স্থানীয় জনগণ আমাদের জানালো যে আসলে বাঙ্গালী-বিহারী দাঙ্গা নয়- সেনানিবাসের মিলিটারীরা সাদা পোষাকে বাঙালীদের নির্বিচারে হত্যা করছে এবং ইতিমধ্যে তারা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেণ্ট মাহতাব বেগ, তার পুত্র এবং আরো অনেক লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। বুঝলাম উচ্চতর মহলে যতই আলোচনা চলুক আসলে মিলিটারীরা দেশে একটি বিশৃঙ্খল ও জঙ্গী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় বা দেশকে আর্মি এ্যাকশন-এর দিকে ঠেলে দিতে পারে।