পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৭

গাড়িতে আমাকে পৌঁছে দেয়া হয়। ডিসি’র বাংলোর গেট বন্ধ, পাশের সার্কিট হাউসের গেট খোলা। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গেটের পাহারাদার সৈনিক এমন অভদ্র এবং কর্কশভাবে আমাদের অভ্যর্থণা করে ভিতরে নিয়ে গেল যাতে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। গাড়ী বারান্দায় বেশ কয়েকজন মিলিটারী অফিসার। এক পাশে ডিসি। তিনি এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মেলাতেই শান্ত স্বরে বললেন আপনি কেন এলেন? বলেই মুখ ফিরিয়ে আরেকদিকে চলে গেলেন। আশ্চর্য ব্যাপার! (পরে ডিসি আমাকে বলেছিলেন যে অস্ত্রের মুখে তিনি সেই স্লিপটা লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন)।একটু পরে আরো ২/১ জন আওয়ামী লীগ নেতা এল লেঃ কঃ তারেক রসুল কোরেশী আমাদের নিয়ে বসলেন। তাঁকে সাহায্য করলেন মেজর তারিক আমিন। কোরেশী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঢাকায় আপনাদের শেখ সাহেব প্রেসিডেণ্টের সংগে আলাপে রয়েছেন। আলাপের ফলাফল যাই হোক কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই সামরিক আইন জারী করা হয়েছে। আমি আপনাকে বলছি, আপনার লোকজনকে জানিয়ে দিন, তারা যেন আমাদের সাথে সহযোগিতা করেন। বলেই তিনি অন্যান্যদের চলে যেতে বললেন কিন্তু আমাকে থাকতে বললেন। মিলিটারী অফিসাররা সবাই উঠে চলে গেলে আমি একাই চুপচাপ বসে আছি। পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে থাকতে বললেন কি আরো কিছু আলাপ করার জন্য, নাকি চা খাওয়ানোর জন্য। এই মেজর আর কর্নেল যে কতদিন আমার বাসায় চা খেয়েছ, কত সহজ ব্যবহার করেছে কিন্তু আজকের ব্যবহারের সঙ্গে তার কত প্রভেদ। আজকে মনে হচ্ছে তারা যেন চেনেই না।

 যাক, তখন প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে। ১১টা থেকে কারফিউ। কারো পাত্তা নেই উঠে চলেই যাব কিনা ভাবছি। একবার উঠেই দাঁড়ালাম অমনি দরজায় স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকটি ভাঙা গলায় হুকুম করলো“বয়ঠো”। আর কি মুশকিল। তার মিনিট পাঁচেক পরে কোরেশী এসে বললো, “আপনি বাসায় চলে যান। বাসাতেই থাকবেন।” তাঁকে বললাম, ১১টা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট, রিকশা পাবার কোন আশা নেই। দয়া করে তোমার গাড়ি করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলে বলতেই “সরি” বলে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। আমার তো ব্যবহার দেখে অবাক হবার পালা। আমি দ্রুত বেরিয়ে হেঁটে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। পরে ক্যাপ্টেন নজরুলের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা শুনেছি। নজরুল বাঙালী। তিনি পাশের ঘরেই অসুস্থ বলে মুখে কাপর ঢেকে শূয়ে ছিলেন। ঘটনাটি ছিল আমাকে নিয়ে কি করা হবে।৪/৫ জন মিলিটারী ফফিসার কিছুতেই একমত হতে পারছিল না। মেজর জিলানী নামে একজনের মত ছিল ঝামেলা করে লাভ নেই, এখন রেখে দিয়ে রাতে শেষ করে দেয়া হোক। কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর মত ছিল সৈয়দপুরের সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়া হোক- যা করার সেখানেই আজকে রাতের মধ্যে করা যাবে (ইনিই আমার বাসায় চা খেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি)। শুধু মেজর তারিক আমিনের মত হল আমরা তার সম্পর্কে যখন কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাইনি তাই এখন অন্য কিছু না করে বাসায় অভ্যন্তরীণ করে রাখা হোক (অথচ কয়েকদিন আগে ছাত্রদের একটা মিছিলের ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড বাদানুবাদ হয়েছিল)। লে; দুররানী নামে একজন অফিসার তাকে সমর্থন করে এবং এই দররানীকেই দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য।

 বাসায় আছি। কারফিউ। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। সামনে দিয়ে কয়েক মিনিট পরপর মিলিটারী টহল। একটা অসহ্য অবস্থা। এর মধ্যেও যতটুকু সম্ভব আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা চালাতে লাগলাম। আমি বিশেষ করে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলাম ইপিআর-এর সুবেদার মেজর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কারণ বেশ কয়েক মাস, বিশেষ করে নির্বাচনের পর থেকেই, তার সঙ্গে আমার বহু গোপন বৈঠক হয়েছে। ইপিআর-এ যদিও কিছু বাঙালী অফিসার ছিল কিন্তু কেন যেন আমি তাদেরকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। সেই কারণে সুবেদার মেজর রউফ এবং তার মাধ্যমে দিনাজপুর ও রংপুর জিলার বাঙালি ইপিআর-দের সাথে এই বিষয়ে আমার পক্ষে গোপন যোগাযোগ সম্ভব হয়েছিল। তখন দিনাজপুর ও রংপুর একই সেক্টরের অধীনে ছিল এবং দিনাজপুর ছিল সেক্টর হেডকোয়ার্টার। এই অবস্থাতেই বাসার পেছনের দিক থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মাড়োয়ারী পট্টিতে এক বাসায় তাঁর সাথে আমার সংক্ষিপ্ত