পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩৮

আলাপ হল। আমি শুধু জানতে চাইলাম আমাদের পূর্বপরিকল্পনা ঠিক আছে কিনা এবং সেই মোতাবেক কাজ করতে কোনো বিশেষ অসুবিধা আছে কিনা। তিনি জানালেন সব ঠিক আছে। তখন সময় ২৬ শে মার্চ রাত ৯টা। সিদ্ধান্ত হলো ২৮ শে মার্চ দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করব। ইতিমধ্যে আমার করণীয় সম্পর্কেও তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমার কাজ ছিল দিনাজপুর জেলার পশ্চিম সীমান্তের ইপিআর ফাঁড়ি থেকে বাঙালি ইপিআর-দের উপরোক্ত সময়ের পূর্বেই এক জায়গায় জমায়েত করা। বাসায় ফিরেই আমার স্ত্রীকে বললাম আমাদের দু'জনের একসঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় অথচ আমাকে যথাশীঘ্র সম্ভব বাইরে চলে যেতে হবে।

 সকাল হল। বাইরের রাস্তায় মিলিটারী টহল। আমি বেলা ৯ টার দিকে আমার স্ত্রী এবং ছোট বাচ্চাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বাসার পেছন দিয়ে প্রাচীর টপকে রাস্তায় একটা রিকশা নিলাম। রিকশা দ্রুত চালাতে বললাম। প্রথমে যেতে বললাম মুন্সিপাড়া। এই চরম দুর্দিনে জুগলু এবং আব্দুর রহীম সাহেবের খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। হঠাৎ রিকশাওয়ালা আমাকে উর্দুতে বলল প্রফেসার সাহেব, আপনি যত শীঘ্র পারেন টাউন ছেড়ে চলে যান। আমি জানি আপনার খুবই বিপদ। এতক্ষণ এদিকে খেয়ালই ছিল না যে রিকশাওয়ালা অবাঙালি অথচ সেই আমাকে প্রাণ বাচাঁনোর জন্য সরে যেতে বলে। যাহোক, জুগলু এবং রহীম সাহেব নেই, তারা শহর ছেড়ে চলে যেতে পেরেছেন। তারপর শাহ মাহতাবের বাসায় যাই। তাকে আর এক বাসা থেকে খুজে ঁনিয়ে রিকশাওয়ালাকে বললাম কাঞ্চন ঘাটের দিকে যেতে। সে বলল কাঞ্চন কলোণী এবং কাঞ্চন ঘাটে মিলিটারী পাহারা দিচ্ছে। সে এক বাঁধের কাছে আমাদের ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অতিক্রম করে নদী পার হতে বললো। আমি রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। সে বলল আল্লাহ আপনার হেফাজত করুন।

 বাঁধ পার হতেই দেখি নদীর পশ্চিম পাড়ে ২/৩ হাজার লোক লাঠিসোঁটা বল্লম ইত্যাদি নিয়ে জড় হয়েছে। ওরা আমার গ্রামের ও আশেপাশের লোক। ওরা শুনেছে আমাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবার জন্যই ওরা সমবেত হচ্ছে। তাও আবার লাঠি-বল্লম নিয়ে মিলিটারীর মোকাবিলা- মনে মনে হাসলাম। আমাকে দেখেই ওরা আনন্দে উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে গেল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিক্ষণ সইল না। হঠাৎ কয়েক রাউণ্ড গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ৫/৬ জন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল। আর ২ জন গুরুতর আহত। বেশ দূরে একখানা জীপ থেকে নেমে আমাকে লক্ষ্য করেই গুলি। আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম কিন্তু আমারই জন্য কয়েকটা অমূল্য প্রাণ চলে গেল।

 এদিকে আমি চলে যাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই মিলিটারীরা টের পেয়ে যায় যে আমি যেভাবেই হোক বাসার বাইরে চলে গেছি। তখনই তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আমার খোঁজে। বিশেষ করে আমার গ্রামের বাড়ি যাবার রাস্তায় কাঞ্চন ঘাটের কাছে যখন তারা আমার সন্ধান পেল তখন আমি কয়েক হাজার লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে জীপ থেকে নেমে কয়েক রাউণ্ড গুলি করেই তারা চলে যায়। নদী পার হতে সব কাপড় ভিজে গিয়েছিল। ভেজা কাপড়েই কয়েক মাইল হেঁটে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছি। পৌঁছেই প্রথম কাজ হলো কয়েকজন লোককে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করা। সেতাবগঞ্জের রউফ চৌধুরীকে লিখলাম তুমি সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের সব ক'খানা ট্রাক বিভিন্ন ইপিআর শিবিরে পাঠিয়ে দাও। তাদেরকে নিয়ে রাতের মধ্যে আমার গ্রামের কাছে সমবেত হও। রাত ২/৩ টার মধ্যেই ২/৩ খানা ট্রাকে ভর্তি ইপিআর দেওয়াদিঘী হাটখোলায় হাজির। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হল। তারা সকালের পূর্বেই কাঞ্চন ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে গ্রামের আড়ালে পজিশন নিল।

 ২৮শে মার্চ রবিবার। সেই বিশেষ মূহূর্তটি উপস্থিত হল যার জন্য কয়েক মাস কত গোপন আলোচনা, শলাপরামর্শ উত্তেজনা। বেলা তিনটা বাজার পূর্বে প্রথমেই ৬ পাউণ্ডার এর গুলির শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় সৃষ্টি হল যেন। আসলে অপারেশন শুরু হয়েছে বলে ২টা থেকেই। কুঠিবাড়ি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যত অবাঙালি ইপিআর জওয়ান এবং অফিসার ছিল তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। কারণ গুলির শব্দ হলেই