অনেক নেতা, এমএনএ, এমপিএ কোলকাতায় পৌঁছে গেছেন। ১০ই এপ্রিল তারিখে ১০ নং লর্ড সিনহা রোডেই নেতৃবৃন্দ এবং অনেক এমএনএ, এমপিএ’দের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার পর সরকার ও মন্ত্রিসভার কাঠামো এবং সদস্যগণের নাম ঠিক করা হয়। পরবর্তী ১৭ই এপ্রিল তারিখে এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকতার রূপ গ্রহণ করে। সেখানেই স্বাধীনতার সন্দ ঘোষণার পর আমি মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে শপথ পাঠ করাই। শতাধিক দেশী-বিদেশী সংবাদ সংস্থার বেতার-টেলিভিশন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে একটি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রথম আইনানুগ আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং সরকারের মাধ্যমেই সারা বিশ্বের জনগণের নিকট আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য-সহানুভূতি ও সক্রিয় সমর্থন কামনা করা হয়।
এরপরে নেতৃবৃন্দের জন্য বাসস্থান নির্দিষ্ট হয় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সপরিবারে থাকেন, সিআইটি রোডে আশু বাবুর বাড়ীতে। অবশ্য মন্ত্রী সাহেবরা বরাবর থিয়েটার রোডের অফিসে বসতেন। কোলকাতা মিশন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণার পর সেখানে খন্দকার মোশতাক সাহেবের পররাষ্ট্র বিষয়ক অফিস বসে। আর বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের হিসাব সংরক্ষণের জন্য প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে আমাকে সেখানে বসতে হত। বিদেশী চাঁদা ও সাহায্যের সমন্বয় করতেন মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী। হোসেন আলী সাহেব, তাঁর স্ত্রী এই মিশনে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কোলকাতায় ফিরে একটি নতুন দুশ্চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করল। চিন্তা করলাম মুজিবনগরে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠের সংবাদ শুধু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদটি পাক সেনারা কিভাবে গ্রহণ করবে? আমি জানি না এই মুহূর্তে আমার পরিবারের লোকজন কে কোথায়! গ্রামের বাড়ি থেকে আসার সময় শুধু মা এবং স্ত্রীকে বলে এসেছিলাম ‘যাচ্ছি'। কোথায় যাচ্ছি, কখন ফিরবো, আদৌ ফিরব কিনা সে মুহূর্তে সেই চিন্তার একেবারেই অবকাশ ছিল না। শরীরের কোন স্থানে কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বেদনা বোধ হয় না হয় পরে, ঠিক তেমনি সেই সময়ই এই চিন্তা আমাকে ভীত ও আতঙ্কিত তরে তুলল। কামরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাঁরও একই অবস্থা। আনন্দ বাজার পত্রিকার মালিক অশোক বাবু তাঁর গাড়ী এবং কিছু পথ খরচ আমার হাতে দিলেন। আমি এবং হেনা ভাই (কামরুজ্জামান সাহেব) রওয়ানা হলাম আপন আপন পারিবারের সন্ধানে ২০শে এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে। রাতে এসে পৌঁছলাম কৃষ্ণনগর ডাক বাংলোয়। সেখানে শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। মনে ভীতি, অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বাইরে এই দুর্যোগের রাত। সেখানেই মধ্যরাতে আমাদের কাছে এসে পরিচয় দিয়ে দেখা করলেন চুয়াডাংগার আওয়ামী লীগ নেতা এবং একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আসহাবুল হক। তাঁর সাথে প্রায় সারারত ব্যাপী আলোচনা হল পশ্চিম সেক্টরে যুদ্ধের কথা। বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে তাঁকে নির্দেশ দিয়ে আমরা পরদিন সকালে রওয়ানা হলাম। মুর্শিদাবাদ জেলার ‘ভাবতা' নামক স্থানে হেনা ভাই-এর পরিবারের সবারই খোঁজ পাওয়া গেল। তিনি অনেকটা নিশ্চিত হন কিন্তু আমার অবস্থা! পরদিন বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির আমরা পরিদর্শন করলাম। পরিদর্শন মানে উদ্বাস্তুদের দুঃখ এবং সর্বনাশের করুণ কাহিনী শোনা। পরদিন পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে এসে আমরা রাধিকাপুর-ডালিমগাঁও উদ্বাস্তু শিবিরে যাই। দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার অনেক নেতার সাথে দেখা হল সেখানে। স্থির হলো ১লা মে তারিখে বেলা ১০ টায় রাধিকাপুর প্লাটফর্মে আমরা সকলে মিলে সভার করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। ইতিমধ্যে খোঁজ পেয়ে গেলাম আমার পরিবারের। রায়গঞ্জ শহরে এক বাসার বারান্দায় পেলাম আমার স্ত্রী এবং মেয়েদের। ছেলে দু’জন সেখানে ছিল না। তারা সীমান্তের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে অন্যান্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। এরা কি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়দিনে কে দুঃখ দুর্গতির মধ্যে দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে তার কাহিনী আমি শুনলাম। তবে অনেক পরিবারের বুকফাটা কাহিনীর তুলনায় এ আর কতটুকু!
পরদিন ১লা তারিখে গেলাম রাধিকাপুরে সভা করতে। গিয়েই শুনলাম এক শিবিরে এক বৃদ্ধা মরণাপন্ন, মৃত্যুর পূর্বে আমাকে একটু দেখতে চায়। এদিকে সভার সময় হয়ে গেছে। তবু গেলাম মৃত্যুপথযাত্রীকে