২৭ তারিখ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র হতে মেজর জিয়া কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা যায়। ঐ ঘোষণার প্রথমে তিনি নিজেকে প্রেসিডেণ্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন পরে তিনি তা সংশোধন করে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করেন। তার নেতৃত্বে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জোয়ানরা কালুরঘাটে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বলেও আমরা খবর পাই। ডঃ মল্লিক কালুরঘাট স্টেশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।
এই বেতার ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করা আমাদের কারো পক্ষে আর নিরাপদ ছিল না। মল্লিক সাহেব ক্যাম্পাসে অবস্থানরত মহিলা ও শিশুদের আগে সরাবার ব্যবস্থা করেন। ৩০ মার্চ সকালের দিকে অন্যান্যদের সঙ্গে আমার পরিবার কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় হোস্টেলে আশ্রয় নেয়। অপরাহ্নে আমরাও মিলিত হই তাদের সঙ্গে। নিরাপত্তার আশঙ্কা আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলছিল সর্বত্র। ফজলুল কাদের চৌধুরীর লোকেরা সেখানে আমাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে শুরু করে। আমরা সত্ত্বর সে স্থান ত্যাগ করে নাজিরহাটে চলে যাই। এখানে মল্লিক সাহেব, ডঃ আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহসান এবং আরো অনেক শিক্ষক অবস্থান করছিলেন। ডঃ মল্লিক চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। তারা সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেন। সকলে চলে যাবার পর আমরা প্রায় আরো এক সপ্তাহ সেখানে কাটাই। এ সময় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে সেতু উড়িয়ে তারা যোগাযোগ বিছিন্ন করতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা কয়েকটি পরিবার নৌকায় করে রামগড় টি এস্টেটে চলে যাই। সেখানে একরাত কাটাবার পরই হানাদার বাহিনীর অভিযানের সংবাদ ও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। অতি সত্ত্বর আমরা নদী পার হয়ে ভারতের সাবরুমে একটি একটি প্রাইমারী স্কুলে এসে পৌঁছি। এখানে সপ্তাহখানেক অবস্থান করি। স্কুলের একেকটি কামরায় প্রায় ১০ টি করে পরিবারকে এই ক'দিন কোনমতে থাকতে হয়েছিল। এরপর আগরতলায় এসে ডঃ মল্লিক ও বাংলাদেশ থেকে আগত অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। এখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করি। একটি টেকনিক্যাল স্কুলের পরিত্যক্ত হোস্টেলে সপরিবারে আশ্রিত হই। মে মাসের প্রথম দিকে ডঃ মল্লিক কলকাতায় যান। সৈয়দ আলী আহসানও তার পরপরই চলে যান।
আগরতলায় শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এসব ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবক ও ছেলেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি এসব ক্যাম্পে যাতায়ত করেছি এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছি। এখানে মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, মেমজর মীর শওকত আলী প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও মাঝে মাঝে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হত। মেজর নুরুজ্জামান আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন।
ইতিপূর্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করা এবং শরণার্থী শিক্ষকদেরকে নানাভাবে সহায়তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি” নামে একটি প্রতিষ্ঠান সংগঠিত হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের ঠিকানা ও বিবরণ চেয়ে পাঠানো হয়েছিল যাতে তারা ভারতে কোথাও কোনভাবে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে পারেন। তাঁদের এই আহ্বান অনুযায়ী আমি আমার বায়োডাটা পাঠিয়েছিলাম। কিছুদিন পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর আগরতলা এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ছিলেন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ। আমাকে বললেন, তুমি তো বোঝই আমাদের এখানে চাকরির অনেক অসুবিধা। তবে তোমার জন্য বোধ হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। আমি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছিলাম এবং সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে উন্নীত হয়েছিলাম। তাই তিনি বোধ হয় আমাকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে কলকাতা যেতে আহ্বান জানান এবং বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দেন।
কলকাতায় গিয়ে আমি মুজিব নগর সরকারের অফিসে দেখা করি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল। তিনিও আমাকে আশ্বাস দিলেন। ইতিমধ্যে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবও শরণার্থী শিক্ষকবুদ্ধিজীবিগণের জন্য বিদেশের একটি সাহায্য সংস্থা হতে কিছু অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন।