পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৫৩

আমাদের জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল বলে আমার পত্রিকার নামটিও “জয় বাংলা” রাখি। মুক্তিযুদ্ধের একটি মুখপত্রের জন্য এর চেয়ে কোন যোগ্য নাম আমার মনে আসেনি।

 মুক্তি সংগ্রামের স্বপক্ষে এবং সুনিয়ন্ত্রিত এক সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে ‘জয় বাংলা’য় লেখা হত। নানা রকম পরিস্থিতিতে জনগণের কি করণীয় সে সম্পর্কেও মতামত ব্যক্ত করা হত। নিজেদের দোষ ত্রুটি এবং সকল প্রকার অনাচারের প্রতিও জোরালোভাবে পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কার্যাবলীর রিপোর্ট সংগ্রহ ও প্রকাশের মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। এটি আমার একক প্রচেষ্টা ছিল। লেখা, রিপোর্ট সংগ্রহ, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণের ব্যবস্থাও আমিই করতাম। সম্পাদকীয় মন্তব্য ও বিভিন্ন রিপোর্ট আমি সাধারণতঃ রাতে এবং খুব ভোরে লিখতাম। তারপর প্রায় সারাদিন ধরে প্রেসে বসে হাত-কম্পোজ শেষে প্রুফ দেখে ছাপা হবার পর বিকেলে পত্রিকার বাণ্ডিল নিয়ে প্রেস থেকে বের হতাম। মুসলিম লীগের সাবেক এম,পি,এ, জনাব কাজী শাহ মাহমুদের মালিকানাধীন প্রেসের জন্য কোন বিপদ না আসে সে কারণে কাজী সাহেবের অনুরোধে পত্রিকায় প্রেসের নাম ছাপা হত না। প্রেসের ম্যানেজার ও কম্পোজিটর যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে কাজ করতেন।

 ২৬শে মার্চ থেকেই আমরা নিজেদেরকে স্বাধীন হিসেবে গণ্য করছিলাম। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কোন সরকার গঠিত না হলেও এক গোপন সরকারের অস্তিত্ব স্বীকার করে সংগ্রাম পরিষদগুলোকে স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করার জন্য “জয় বাংলা”র প্রথম সংখ্যাতেই মত প্রকাশ করা হয়।

 যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত অপর কোন দৈনিক পত্রিকার অস্তিত্বের কথা আমাদের জানা ছিল না (পরে প্রমানিত হয়েছে ঐ সময়ে সত্যি সত্যি আর কোন ‘দৈনিক’ পত্রিকা ছিল না) বলে “জয় বাংলা”র নামের ওপরে “স্বাধীন বাংলার একমাত্র মুখপত্র” কথা কয়টি ছাপা হত।

 “জয় বাংলা” প্রথম থেকেই কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। কোন কোন স্বার্থান্বেষী মহলের হুমকি, এমনকি সম্পাদকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি হুমকিও তোয়াক্কা না করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা এবং সকল প্রকার অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

 ৫ই এপ্রিল রাতে আমি রাইফেল বাহিনীর গোলা বারুদের জীপে চড়ে বগুড়া যাই। বগুড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও মুক্তাঞ্চল সফর শেষে ৭ই এপ্রিল সন্ধ্যায় নওগাঁ ফিরে আসি। এ কারণে ৬ই ও ৭ই এপ্রিল দু’দিন “জয় বাংলা” প্রকাশিত হয়নি। ৮ই এপ্রিল বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার এবং বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে ৮ম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। এ সফরকালে আমি বগুড়ার তৎকালীন ডিসি এবং এসডিও সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বগুড়ায় আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানাই।

 এ বিশেষ সংখ্যায় হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বগুড়া শহর রক্ষা এবং মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আড়িয়ার বাজারে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনী গোলা বারুদের ডিপো দখলের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়। এছাড়া মুক্তাঞ্চলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোর কর্মীদের সহায়তায় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে শান্তিশৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব প্রদানের কথাও লেখা হয়।

 ‘জয় বাংলা’র ১১শ এবং শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১। এ সংখ্যায় যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য জবাসস (জয় বাংলা সংবাদ সংস্থা) গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে যেসব খবর পাচ্ছিলাম সেগুলো একটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই এটি আমি গ্রহণ করি। আমাদের কোন নিজস্ব সংবাদ সংস্থা ছিল না এবং কেউ সে রকম কোন উদ্যোগ না নেয়ায় সীমিত সামর্থ্য নিয়েই ‘জবাসস’ গঠন করি। মুক্তাঞ্চলের কিছু টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। এ কাজে জনাব সলিম মণ্ডল, পাঁচবিবি এক্সচেঞ্জের শ্রী উপেন্দ্রনাথ ঘোষ ও আরও অনেকে বগুড়া সাকিংট হাউজস্থিত মুক্তিযোদ্ধা