বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড
বিজয়ের পর কবে এবং কিভাবে আমি দেশে ফিরে আসি তার সঠিক তারিখ কিছুতেই মনে করতে পারছি না— একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে জেনারেল অরোরার সৌজন্যে তাঁর বিমানে করে ঢাকায় ফিরি। প্রায় দু’দিন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেও যখন ঢাকাগামী কোনও বিমানে জায়গা পেলাম না জানতে পারলাম জেনারেল অরোরা ঢাকায় যাচ্ছেন, তাঁকে অনুরোধ জানান মাত্র তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে নিতে রাজি হন। ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর অধিনায়কদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটাবার এবং কথা বলার একটি অমূল্য সুযোগ আমার এভাবে দৈবাৎ মিলে গিয়েছিল। মনে পড়ে সিলেটের ভারতীয় ছাউনিতে অফিসারদের সঙ্গে জেনারেল আরোরা তাদের মেসে এক মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। তাঁর মেহমান হিসেবে আমিও এই ভোজে শরীক হই। এ উপলক্ষে আমার কয়েকজন জেনারেল এবং অন্ততঃ একজন এ্যাডমিরালের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের কিছু কথা এবং ইঙ্গিত আমাকে বিস্তৃত করেছিল। স্মরণযোগ্য যে স্বাধীনতা লাভের আগের মুহূর্তে ‘আল বদর’ পৈশাচিক নিপুণতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ক’জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল। জাতির হৃদয়ে অনেক শোকের মধ্যে এ শোকটি বড় বেশীরকম আঘাত হেনেছিল। ভারতীয় অফিসারদের কথাবার্তা থেকে আমার মনে হয়েছিল তাঁদের ধারণায় আগেই এ ব্যাপারটি ঘটেনি এবং এ বাঙালীদের গুজব সৃজন কুশলতার আরেকটি প্রমাণ। আমি মরিয়া হয়ে অফিসারবৃন্দকে বলেছিলাম যে দীর্ঘ নিহতদের তালিকায় আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয় অন্ততঃ চারজন অধ্যাপক ছিলেন এবং আমি নিশ্চিত করে জানি তাঁরা পাকিস্তান পরিচালিত আল বদরের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছিল।
বিমান ভ্রমণের সময় জেনারেল অরোরার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে আলাপ হয়। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম; মিত্রবাহিনীর হাতে পাকিস্তানের এত দ্রুত পরাজয়ের কারণ কি। জবাবে তিনি তিনটি প্রধান কারনের উল্লেখ করেছিলেন:
৯ নভেম্বর; ১৯৮৪
সিরাজুর রহমান
১৯৭১ সালে বিবিসিতে কতকগুলি সমস্যা ছিল। আমাদের শ্রোতাদের সঠিক তথ্য পরিবেশন করতে হবে, সর্বশেষ এবং সঠিক খবর তাদের জানাতে হবে কিন্তু সেই খবরগুলো আমরা পাই কোথায়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকার ফলে সংবাদ সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এই অসুবিধার ভেতর দিয়ে যথাসাধ্য আমাদের সংবাদ সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এরুপক্ষেত্রে যা হয়, যেখানে সত্যিকারের সংবাদ পাওয়া কঠিন হয়ে যায় সেখানে মিথ্যা সংবাদ অজস্র আসতে থাকে, গুজবগুলো সংবাদের আকার নেয়। আমাদের পক্ষে আরো বড় সমস্যা ছিল যে, বাংলাদেশ-ভারতের বাংলাভাষী শ্রোতারা, যাদের নিয়ে আমাদের কাজ কারবার, বরাবরই তাদের জন্য আমাদের সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। কিন্তু যদি কখনো অজান্তে গুজবের বেসাতি করে আমরা এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করে ফেলি যে আমরা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চল সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ দিয়ে থাকি তাহলে ভবিষ্যতে কখনো শ্রোতারা