পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৩

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খন্ড

আমাদের বিশ্বাস করবেন না। এক দিকে যাতে কেউ বলতে না পারে যে আমরা খবর অন্যান্যদের পরে দিচ্ছি, দ্বিতীয়ত আবার কেউ যাতে অভিযোগ করতে না পারে আমরা মিথ্যা খবর দিচ্ছি। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়েছে দু’কূল বজায় রেখেই সর্বশেষ ও সঠিক সংবাদ পরিবেশন করতে। এই ছিল আমাদের মূল সমস্যা। এছাড়া আমাদের অনুষ্ঠানের সময় ছিল খুব কম, বেশি খবর দেয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। অবশ্য পরবর্তীকালে আমাদের অনুষ্ঠানের সময় বাড়ানো হয়েছিল।

 আমরা বাংলা বিভাগে যারা ছিলাম সংখ্যায় অত্যন্ত কম ছিলাম। আমাদের পক্ষে সবকিছু সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। সৌভাগ্যবশতঃ তখন আশেপাশে কিছু ছাত্র ছিলেন তাঁরা এ দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। আমার মনে আছে আমার সহকর্মী শ্যামল লোধ, কমল বোসসহ কোন কোন সময়ে দিনের পর দিন আমরা সকাল ৯টার সময় এসেছি আবার রাত ২/৩টার সময় ট্রান্সমিশানগুলোর কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছি।

 এর মধ্যে আবেগেরও বহু ব্যাপার ছিল। দেশ থেকে অবিরাম খবর আসছে। দেশের জনসাধারনের দুঃখ দুর্দশা বৃহত্তর ভোগান্তি ইত্যাদি নানা কাহিনী শুনে আমাদের মন আবেগে মন আবেগে আপ্লুত হয়ে যেত। সে দিকটি তো ছিলই। তার ওপর আর একটা বড় সমস্যা ছিল আমাদের হাজার হাজার বাঙ্গালী যারা পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল। দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার কোন উপায় ছিল না তাদের। দুই তরফ থেকে তারা আমাদের শরাপন্ন হয়েছিলেন। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম বিবিসি বাংলা বিবাগের প্রতি তাদের ভালোবাসা কতটুকু। কারণ বেপরোয়া হয়ে তারা আমাদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। প্রথমত আমরা বাংলাদেশ থেকে পাওয়া কিছু চিঠি পাকিস্তানের আত্মীয়স্বজনদের অথবা পাকিস্তানে আটকে পড়াদের চিঠি বাংলাদেশের তাদের আত্মীয়স্বজনদের পাঠানোর চেষ্টা করেছি। বেশ কয়েক হাজার চিঠিপত্র এভাবে এদিকওদিক গিয়েছিল। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল ছিল না এগুলো দেখাশুনা করার জন্য। শেষ পর্যন্ত আমরা ‘সেতু বন্ধন, সাগর পাড়ের বাণী’ অনুষ্ঠানে তাদের খবরাখবর বিনিময় শুরু করলাম। অজস্র চিঠি আমরা সে সময় পেয়েছি। এর ভেতর দিয়ে আমাদের শ্রোতারা কত একাত্মবোধ করেছেন সেই প্রমাণ আমরা সেই সময়ে পেয়েছি।

 আরো মনে পড়ে, যখন ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে আমরা টের পেয়ে গেলাম যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করবে তখন আমরা নতুন একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করছিলাম। আমার মনে আছে যখন আমরা সেই অনুষ্ঠানটি প্রচার করি ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমি কানে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনছিলাম এবং মুখে আমাদের শ্রোতাদের খবর দিয়ে যাচ্ছিলাম যে ইয়াহিয়া খান তখন কি করছেন- একই টেইপে। অর্থ্যাৎ ইয়াহিয়া খান যে মুহূর্তে বেতার ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন ইংরেজিতে সেই মুহুর্তে ভারত-বাংলাদেশে আমাদের বাংলা অনুষ্ঠানের শ্রোতারা এই বিষয়ে অনুষ্ঠানটির মারফতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটা শুনতে পেরেছিলেন। আবেগে তখন মনটা এ রকম হয়ে পড়েছিল যে কান্না চাপাটাই খুব অসুবিধাকজনক হয়ে গিয়েছিল। অথচ আমি জানববেতার সাংবাদিকদের পক্ষে আবেগ-অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেয়া অত্যন্ত অযোগ্যতার পরিচয়। কিন্তু তবুও সেদিন কান্না চেপে রাখা কষ্টকর ছিল।

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ দেশের প্রবাসী বাঙ্গালীরা বিশেষ ভুমিকা নিয়েছিলেন এটা বলতে হবে। এখানে আমার কিছু বাঙ্গালী বন্ধু ছিলেন, তারা একটা ছাত্র সংগ্রামে পরিষদ গড়ে তুললেন এবং আমার সাহায্য চাইলেন। সাব্যস্ত হলো আমি তাদের সাহায্য করবো জনসংযোগ ও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে ছিলেন ওয়ালী আশরাফ, মাহমুদ হোসেন মঞ্জুর, মোশারফ হোসেন, বুলবুল মাহমুদ, মানিক চৌধুরী, শামসুদ্দীন প্রমুখ। সুরাইয়া খানমও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা সম্বন্ধে বিশ্বের জনসাধারণকে তাঁরা অবহিত করবেন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সাংবাদিক, বেতার-সাংবাদিক শিক্ষাব্রতী এবং বিশেষ করে দেশের বাইরে যারা আছেন তাঁরা বিভিন্ন দেশের