পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড

 ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইনটেলিজেণ্টসিয়া’ গঠন করা নিয়ে বংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটু ভূল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কেউ কেউ সরকারকে এমন ধারণা দিয়েছিলেন যে সরকারী যে উদ্যোগের বাইরে যেভাবে আমরা এই পরিষদ গঠন করেছি তাতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগের সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। আমাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এমন ধারণা করেছিলেন যে সরকার এক ধরনের দলীয় নিয়ন্ত্রণ আমাদের ওপরে আরোপ করতে যাচ্ছেন। শিক্ষক সমিতি গঠনের পূর্বমুহূর্তেও আবার এ ধরনের একটা ভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম এমপি ও জনাব কামরুজ্জামান এমপি’র মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এক সন্ধ্যায় আমাকে ও আনিসুজ্জামানকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন যে, আনিসুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যুক্ত থাকলে তাঁর কাজে সুবিধা হবে অতএব তাঁকে যেন শিক্ষক সমিতিতে বড় দায়িত্ব না দেয়া হয়। আমিরুল ইসলামও এই বক্তব্য সমর্থন করেন। কিন্তু আমরা আগে থেকে যেভাবে ভেবে এসেছিলাম তার ফলে এই প্রস্তাবে সম্মত হইনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা সেল গঠন করলে ডঃ মুজাফফর আহমদ, ডঃ সারওয়ার মুর্শিদ, ডঃ মোশাররফ হোসেন ও ডঃ স্বদেশ বসুর সঙ্গে ডঃ আনিসুজ্জামানকে তার সদস্য করা হয় তখন আনিসুজ্জামান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন এবং সেই ভার অর্পিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ অজয় রায়ের ওপরে।

 শিক্ষক সমিতির কাজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের সাহায্য করা, শরণার্থী শিবিরে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় চালানো, প্রচার পুস্তিকা প্রণয়ন করা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন চেয়ে পত্র লেখা ও পুস্তিকা প্রেরণ করা এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রচারাভিযান চালানো। বহু শিক্ষককে আমরা সহায়ক সমিতির তহবিল থেকে সাহয্য করতে পেরেছিলাম, শরণার্থী শিবিরে কিছু কিছু বিদ্যালয় খুলে বালক-বালিকাদের মধ্যে একট শৃঙ্খলা রাখার ও শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। কয়েকটি পুস্তিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম ইংরেজিতে তার মধ্যে ‘পাকিস্তানবাদ ও বাংলাদেশ’ সম্পর্কে ওসমান জামালের লেখা একটি পুস্তিকা এবং বাংলাদেশে গণহত্যা সম্পর্কে একটি সচিত্র পুস্তিকা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে বংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা চিঠি লিখি এবং আশাব্যঞ্জক ও সমর্থনসূচক উত্তর পাই। অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এল বাসামকে লেখা আমার চিঠি, তিনি আমার অনুমতি নিয়ে সাইক্লোষ্টাইল করে সে দেশের প্রধান মন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজারসহ অনেক নেতাকে পাঠান এবং আমাদের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। আমেরিকা ও লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পরিচিত অধ্যাপকের কাছে লিখা আমার চিঠি মোটামুটি একই ভাবে ব্যবহার করা হয়।

 ভারতে আমরা যে প্রচারাভিযান চালাই, তার প্রথম পর্বেও সম্পূর্ন উদ্যোগ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির। এই সমিতির দিলীপ চক্রবর্তী, সৌরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অনিল সরকার[১] ডঃ অনিরুদ্ধ রায় ও বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে নিয়ে আমি ও আনিসুজ্জামান এলাহাবাদ, আলীগড়, লক্ষ্‌নৌ, আগ্রা ও দিল্লী সফর করি। এসব শহরের বিশ্ববিদ্যালয় অংগন ছাড়াও আমরা বিভিন্ন জনসভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ওপর বক্তৃতা দেই। আমাদের সংগে সুবিদ আলী (এম,পি,এ) যোগ দেন। তিনি প্রয়োজনমতো উর্দুতে আমার ইংরেজী বক্তৃতার অনুবাদ জনসমাবেশে পেশ করতেন। বিষ্ণুকান্ত বলতেন হিন্দীতে। আনিসও আমার মতো ইংরেজীতেই বলতেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু আমাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়। সেখানকার পরিবেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল ছিল না। বক্তৃতা করতে ওঠার আগে সে সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। আমার বক্তৃতার পরে শ্রোতাদের অনেকেই কেঁদে ফেলেছিলেন। বক্তৃতা নাকি মর্মস্পর্শী হয়েছিল, একথা অনেকে বলেছেন।


  1. বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাহায্য-সহায়তা অনিলের গভীর আবেগ নিয়ে জড়িয়ে পড়ার একটি উদাহারণ আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। এক পর্যায়ে শরণার্থী শিক্ষকরা যখন আর কোথাও আশ্রয়ের স্থান পাচ্ছেন না তখন তিনি নিজ বাসগৃহ তাঁদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ীতে গিয়ে ওঠেন এবং তাঁর স্ত্রী প্রতিদিন ভোরে ওই বাড়ীতে এসে রান্নাবান্না ও তাঁদের খাওয়ানোর কাজ সেরে রাত নটার পর তাঁর পিতার বাসায় ফিরতেন।