পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১৯

আহত হয়েছিলেন, তখন নিরাময়ের পথে। সাশ্রুনেত্রে বিদায় জানালেন, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাণী উচ্চারণ করলেন।

 বিদায়ের মুহুর্ত এগিয়ে এল। ডঃআজাদ ও ডঃহক নিবিড় আলিঙ্গনে বিদায় জানাল- আশার বাণী উচ্চারণ করল আবার দেখা হবে- হয়তো মুক্তদেশে। ডঃআজাদকে আর একটি প্রতিবেদন হস্তান্তরিত করলাম বাইরে পাঠাবার জন্য। দেশ মুক্ত হবার পর অনেকের সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু এই নীরব দেশকর্মীর সাথে আর দেখা হল না। চিরতরে তিনি হারিয়ে গেলেন। পথে কোন বিপদ হয়নি। কেবল পাগলার ওখানে আমাদের গাড়ী আটকিয়ে জনৈক মিলিটারী অফিসার আমার পরিচয় ও কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করেছিল। মাকে দেখিয়ে বলেছিলাম ওঁকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনিয়েছিলাম গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা মুক্তি পেলাম। নদীর ধারে গেলাম অসংখ্য লাশ পড়ে রয়েছে। চারদিকে শকুনের উল্লাস। অনেকগুলি নারায়ণগঞ্জ অভিমুখি বাস আটকানো- যাত্রীদের পথের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। শেষ পর্যন্ত ওদের কি হয়েছিল জানি না।

 অবশেষে নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চ ও নৌকাযোগে আমরা আমাদের উদ্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছালাম নূরুল ইসলামের সহয়তায়। আসবার সময় শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে ভেসে যেতে দেখলাম অসংখ্য মৃতদেহ নূরুল ইসলাম জানাল দিন কয়েক আগে নারায়ণগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় মিলিটারী অপারেশন হয়েছে- এ তারই ফলশ্রুতি।

 আমাদের আত্মীয়রা আমাদের গ্রহণ করল সাদরে। অনেকদিন পর মার মুখে দেখলাম আশ্বস্তির ঝিলিক। দাউদকান্দি থেকে বেশ কয়েক মাইল গভীরে গ্রামটি। যাতায়াতের সুবিধা নেই তাই আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের একটি ভাল আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।গ্রামবাসীদের অনেকে এবং আশেপাশের গ্রামসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পলাতক এবং স্থানীয় ছাত্র আমার সাথে যোগাযোগ করল- ঢাকার অবস্থা জানতে চাইল। ওরা জানাল যে আশেপাশের গ্রাম মিলে ওরা একটি ছোটখাটো মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের বড্ড অভাব। পরামর্শক্রমে ঠিক হল আপাততঃ সশস্ত্র প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এখন কেবল সংগঠন গড়ে তোলা আর চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বিশেষ করে দাউদকান্দিতে ঘাঁটি স্থাপন করা পাক বাহিনীর গতিবিধির ওপর। স্থির হল ১০/১২ জনের একটি দল ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে চলে আসবে। ওরা ফিরে এলে আর একটি দল যাবে এবং ক্রমান্বয়ে এই প্রক্রিয়া চলবে যতদিন না স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়।

 কয়েকদিন গ্রামে কাটালাম। একদিন রাতে দাউদকান্দি কুমিল্লা মহাসড়কের দুপাশে কয়েকটি গ্রামে মিলিটারী অপারেশন চালাল। এর ঢেউ আমাদের গ্রামেও এসে লাগল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হিন্দু জনসাধারণ। আমার আত্মীয়রাও স্থির করল ওরা ভারতে চলে যাবে কিছু দিনের মধ্যেই। তাই স্থির করলাম ভারতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার। স্থির হল ২২শে মে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। স্থানীয় মুক্তিবাহির একটি ছোট দল আমাদের সাথে যাবে তবে ওরা ভিন্ন পথে, আমরা মিলিত হব সি এণ্ড বি রোড পার হয়ে গোমতী নদীর ওপারে। গভীর রাত্রে একজন পথ প্রদর্শক সাথে নিয়ে আমরা আবার পথে নামলাম। দীর্ঘপথ কখনও হেঁটে, কখনও নৌকাযোগে পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম চান্দিনার কাছে এক গরীব নাপিতের বাসায়। পরদিন রাত্রে আমরা অতিক্রম করলাম সবচাইতে বিপজ্জনক পথ চান্দিনা কুমিল্লা রোড এবং পরে সি এণ্ড বি রোড। অতিক্রম করলাম গোমতী নদী, ওপারে মুক্তিবাহিনীর দলটির সাথে দেখা হল। আমরা সেখান থেকে বুড়িচং হয়ে নয়নপুরের কাছ দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলাম। প্রণাম জানালাম দেশের মাটিকে। চোখে জল এল। ভাবছিলাম আবার কি ফিরে যেতে পারব জন্মভূমির কোলে। দুপুরে আমরা পৌঁছালাম সীমান্ত শহর সোনামুড়ায় ২৪শে মে। ছোট শহরে ভরে গেছে বাংলাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীতে। আপাততঃআশ্রয় পেলাম স্ত্রীর দূর সম্পর্কের বোনের বাসায়। দেখা হল আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সংসদ সদস্য অধ্যাপক খুরশীদ আলমের সাথে। তিনি পূর্বপরিচিত। মুক্তিবাহিনীর ছোট দলটির আগমনের