পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩২৩

 সে সময় ঢাকায় আর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেনঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জম হোসেন, তথাকথিত আগরতলা মামলা ২নং আসামী। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে তাকে তার বাসভবনে থেকে টেনে বের করে এনে উন্মুক্ত রাজপথে গুলি করে মারা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা উদ্দীপনায় কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের অবদান অমুল্য। অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত সধনা ঔষদালয়ের প্রতিষ্ঠাতা; ৩১ শে মার্চ গেণ্ডারিয়ায় তার বাসভবনে এই অশীতিপর বৃদ্ধকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। ড. এস দে বিসিএসআইআর প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী; এপ্রিল মাসে গেণ্ডারিয়ার বাসভবনের কাছে তাঁকে হত্যা করে তাঁর মৃতদহ লোহার পুলের কাছে ফেলে রাখা হয়। ড.শৈলেন ভদ্র, শল্যচিকিসক, শাখারী বাজারের নিকটে তার বাসভবনে ৩১ শে মার্চ পাক বাহিনী তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মির্জাপুর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, সম্ভবত এপপ্রিল মাসের মাঝমাঝি সময়ে তাঁকে ও তাঁর পুত্রকে গভর্নর ভবনে ডেকে আনা হয় সেখান থেকে বের হবার পর সেনাবাহিনীর লেকজন ওদের ধরে নিয়ে যায়- সম্ভবত ক্যাণ্টনমেনটে পিতা পুত্র উভয়কে হত্যা করে। শহীদ সাহেবের, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক কিছুদিন যাবৎ মানসিক রোগে ভুগছিলেন। ৩১ শে মার্চ সকালে সংবাদ অফিস ভবনে অগ্নিসংযোগ করে পাক বাহিনী সদস্যরা তাকে পুড়িরে মারে। জহিরুল আসলাম, ঔপন্যাসিক ও সাংস্কৃতিক, সংগঠক, জিঞ্জিরায় ২রা এপ্রিল তারিখে পাক বাহিনী যে বর্বর নরহত্যাকাণ্ড চালায় তাতে তিনি অন্য অনেকের সাথে নিহত হন। মেহেরুন্নেছা, কবি ও রেডিও মেকানিক, ২ মে মার্চ তাকে বর্বর পাক বাহিনীর সদস্যরা মা ও ছোট ভাইসহ নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। আবু তালিব দৈনিক ইত্তিফাকের সাংবাদিক, ২৯শে মার্চ মিরপুর এলাকায় পাক বাহিনীর কতিপয় অবাঙ্গালী অনুচরদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ডা. আজহার আলী, রেডিওলজিস্ট, নভেম্বরের মাঝামঝি সময়ে খুব সম্ভব ১৬ই নভেম্বর তাকে পাক বাহিনীর অনুচরেরা বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহ ফকিরাপুলের কাছে পাওয়া যায়। ডা. হুমায়ুন কবীর, সদ্য পাশ করা ডাক্তার, ডা. আজহার আলীর সাথে একই সময়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এ দুটি হত্যার খবর আমরা কলকাতয় পাই- ডাকায় যোগাযোগ রক্ষাকারী গেরিলা ইউনিটের কাছ থেকে নভেম্বারের শেষে। ২৮শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চের মধ্যে ইত্তেফাক,পিপলস ও সংবাদ অফিস ভবন পাক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। বেশ কজন লোক এইসব অফিসে নিহত হয়। ঢাকা থেকে আগত লোক মারফত খবর পাওয়া গেল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলের বেশ ক'জন বাঙালী কর্মচারীকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে মেরেছে।

অন্যান্য অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গণহত্যার স্বাক্ষর

 নানা সূত্র থেকে আমরা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে অনুষ্ঠিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহ করি:

 চট্টগ্রাম ও আশপাশের অঞ্চলঃ শ্রী পিসি বর্মন, লোকহিতৈষী চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসী, চট্টগ্রামে মাচের শেষের দিকে সশস্ত্র সংগ্রামের সময় তার বাসভবনে পাক বাহিনী তকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর পুত্রও সম্ভাবত নিহত হয়। জনাব আলী ইমাম, চট্টগ্রাম স্টেট ব্যাংক শাখার কর্মচারী; মার্চ এপ্রিলে পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন। কাজী হাসান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছত্র; প্রতিরোধ যুদ্ধকালে লালখা ঁবাজারে স্বীয় বাসভবনে পাক হানাদারদের হাতে মৃত্যুবরন করেন। শ্রী নতুন চন্দ্র সিংহ, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, একই সময়ে স্বীয় প্রতিষ্ঠনে এই সত্তুর বছর বয়স্ক বৃদ্ধকে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়। কাওসার আহমেদ, চট্টগ্রাম পিআইএ অফিসের তরুণ কর্মচারী। বর্বর পাক বাহীনীর সদস্যরা বিমান বন্দ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। সঠিক সময় জানা যায়নি। শ্রী বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী, প্রবর্তক সংঘের নিবেদিতপ্রাণ বৃদ্ধ পুরুষ; এপ্রিল -মে মাসে এই সংসারত্যাগী বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে পাক বাহিনীর জল্লাদেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। শ্রী শান্তিময় খাস্তগীর, কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ; কলেজের অফিসে কর্মরত অবস্থায় পাক বাহিনীর নির্মম জল্লাদের গুলিতে শহীদ হন। ঘটনাটি ঘটে ৩১শে জুলাই শ্রী অবণীমোহন দত্ত, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবরুদ্ধঅবস্থায় চট্টগ্রাম শহরে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। পালাননি বা পালিয়ে যেতে পারেননি। বাসা থেকে তাকে ও তার ভাইপোকে জল্লাদেরা ধরে নিয়ে যায়, আর ফিরেত পারেননি। চিরতরের জন্য হারিয়ে গেছেন।