পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৫

আব্দুর রাজ্জাক (মুকুল মিয়া)

 ১৯৭১সালের অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় হই। ১০-১৫ই মার্চ থেকে বকুল সাহেবের নেতৃত্বে গোপালপুর জেলা স্কুল মাঠে ছাত্রজনতাকে নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ খোলা হয় এবং তিনি নিজে প্রায় ১৫০/২০০জন ছেলের হাতে বাঁশের লাঠি ও ডেমি রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন আমি আরো ৫/৭জন ছেলেসহ স্থানীয় পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট-এর ওয়ার্কশপ থেকে কাঠের বন্দুক তৈরী করে আমাদের ক্যাম্পে সরবরাহ করি। বকুল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব মরহুম বগা মিয়ার (আব্দুর রব) নেতৃত্বে পাবনা শহরে বেশ কয়েকটি জনসভা হয়। হাজার হাজার সরকারী বেসরকারী কর্মচারী ও জনতা উক্ত জনসভায় যোগদান করেন।

 ২০শে মার্চ জনাব বকুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দলে বিভক্ত করা হয় এবং চারজন ছাত্রনেতার ওপর চারটা দলের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে বকুল সাহেবের নির্দেশে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে পাকবাহিনী পাবনা শাহরে প্রবেশ না করতে পারে।

 একটা দলের ভার শহীদ ছিদ্দিকের উপর অর্পণ করা হয় এবং তার দলকে পাঠানো হয় নগরবাড়ীপাবনা রোডে। একটি দলের ভার আমি নিজে নিয়ে পাবনা-রাজশাহী রোডে থাকি। একটি দলের ভার ইকবালের উপর দেয়া হয় এবং তার দল পাঠানো হয় শালগাড়িয়া রোডে। আর একটি দলের ভার দেয়া হয় বাবুর উপর এবং তাকে পাঠানো হয় পাকশী-পাবনা রোডে। বকুল সাহেব কিছু যোদ্ধা নিয়ে শহরের কণ্ট্রোলরুমে থাকেন।

 ২৩শে মার্চ আমরা সমস্ত পাবনা শহরে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। ঐদিন নক্সালদের সাথে আমাদের নুরুল খন্দকারের বাড়ীতে সংঘর্ষ হয় এবং নক্সালেরা পালিয়ে যায়।

 ২৪শে মার্চ পাক-বাহিনী নগরবাড়ী হয়ে পাবনা শহরে প্রবেশ করে। তাদের ভারী হাতিয়ারের সামনে টিকতে পারবেনা বলে আমাদের বাহিনী বাধা সৃষ্টি করেনি। পাক-বাহিনী পাবনা শহরে প্রতিটি অফিস আদালতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে শহরে কার্ফু দিয়ে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়ে এবং রাতের বেলা অনেক মহিলার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এদিকে আমরা কয়েকটি দল যোগাযোগ করে একত্রিত হই এবং ডিসি ও এসপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে পাক সেনাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিই। আমরা শহরের আশেপাশের গ্রামগুলোতে জানিয়ে দেই যে আগামী কাল আমরা পাক-বাহিনীকে আক্রমণ করবো এবং তারা যেন তাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়। ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার জনতা ঢাল সরকী, ফালা, তীর ধনুক, রামদা, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে ঢোল থালা পিটিয়ে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে চর আশুতোষপুরে এসে জমায়েত হয়।

 ২৪শে মার্চ ভোর রাত ৪টার সময় পাক-বাহিনী পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। পুলিশ বাহিনী পূর্ব হতেই ডিফেন্সে ছিল। পাক-বাহিনী আক্রমণ করার সাথে সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

 ২৫শে মার্চ সকাল ৭টার সময় আমরা বকুলের নেতৃত্বে হাজার হাজার জনতাকে নিয়ে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে শহরে ঢুকে পড়ি এবং পাক-বাহিনীকে আক্রমণ করি। তুমুল যুদ্ধ চলছে এর মধ্য দিয়ে হাজার হাজার জনতা রুটি, ডাব, ভাত ইত্যাদি নিয়ে আমাদের খাদ্যদ্রব্য যোগান দিচ্ছে। জয় বাংলা শ্লোগান শোনার সাথে সাথে পাক-বাহিনী ৪/৫টি দলে ভাগ হয়ে যায়। পরে একত্রিত হয়ে সিনেমা হলের নিকট এসে জমায়েত হয়। এদিকে পুলিশ লাইনে পাক সেনাদের একটি দলের ৮/১০জন নিহত হয়। বাণী সিনেমা হলের কাছে আমরা পাক-বাহিনীর সদস্যদেরকে চারি দিক থেকে ঘিরে ফেললে উপায় না দেখে তারা আত্মসমর্পণ করে। সাথে সাথে হাজার হাজার জনতা এসে তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করে।