পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২০

আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন চাইনিজ রেষ্টুরেণ্টে আলোচনায় বসতাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো যে একদিন একযোগে সবাই পাক বাহিনী ত্যাগ করবো না। কারণ তাতে ধরা পড়লে সবারই একসাথে ধরা পড়ার সম্ভবনা। সিদ্ধন্ত হল ফ্লাইট লেফটেনাণ্ট নূরুল কাদের প্রথমে সীমান্ত অতিক্রমের বিভিন্ন পথ আগে সরেজমিনে জরিপ করে আসবেন এবং পরে তার রিপোর্ট অনুসারে আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে সীমান্ত অতিক্রম করবো। কথামতো নূরুল কাদের পথের খবর নিতে যান। কিন্তু কাজ শেষে ফিরে আসার সময় তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে অবশ্য নানা অজুহাত দেখিয়ে তিনি মুক্তি পেয়ে আসতে পেরেছিলেন এবং আমাদের সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 অন্যান্য অফিসারদের সাথে মিলে দেশ ত্যাগের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে ২৮শে মার্চ আমি এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নেই। বেড়াতে যাবার কথা বলে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ আমার নিজের গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ডেমরা ঘাট পর্যন্ত গিয়ে গাড়ীটি ভেতরে চাবিসহ ফেলে রেখে অনির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে বের হই। ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট মারগুব (পরে বাংলাদেশ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান) আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই পথ দেখিয়ে আমাদের গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

 কিন্তু আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ভাড়া করা লঞ্চে কিছুদূর যাবার পর নদীতে অল্প পানির জন্য আটকে পড়ি এবং শেষ পর্যন্ত ভৈরব বাজারের কাছ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই।

 এপ্রিল মাসের ১০কি ১১ তারিখে রাজশাহী সীমান্ত অতিক্রমের লক্ষ্যে আমরা কয়েকজন মিলে আবার ঢাকা ত্যাগ করি। কিন্তু আরিচা এসে পাক বাহিনীর সমাবেশ দেখে আবার ঢাকা ফিরে আসি। সীমান্ত অতিক্রমের পরবর্তী চেষ্টা চালাই ১০ই মে তারিখে। এবার লক্ষ্য ছিল কুমিল্লার পথে সীমান্ত অতিক্রম করা। নবীনগর পর্যন্ত গিয়ে পাক বাহিনীর সমাবেশ দেখে ফিরে আসি এবং নরসিংদীর কাছে এক জুট মিলের রেষ্ট হাউজে আশ্রয় নেই। মিলের ম্যানেজার ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট রেজা এবং তিনিও আমাদের সাথে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের দলে ছিলেন।

 ১২ই মে রাতে কুমিল্লার কালির বাজারে জনৈক কৃষকের বাড়ীতে রাত কাটানোর ঘটনার স্মৃতি এখনো আমার স্মরণে অম্লান। কৃষকটির বাড়ীতে আমরা বেশ কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাত ২/৩টার দিকে হঠাৎ দরজায় করাঘাত। পাকসেনারা হবে ভেবে কেউ কেউ দরজা খুলতে দ্বিধা করছিলেন। বল্লাম, পাক সেনারা এসে থাকলে দরজা না খুললেও তারা ভেঙ্গে ঢুকবে। যারা দ্বিধা করছিলেন তাঁরাও একমত হলেন যে, দরজা খোলাই সংগত। দরজা খুলে দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে গৃহস্বামী স্বয়ং। তিনি আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছেন এবং বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে আমাদের খাবার দাওয়াত দিতে এসেছেন। দরিদ্র কৃষকের বাড়ী। এত রাতে এতগুলো লোকের জন্য এত ভাল ভাল খাবারের ব্যবস্থা দেখে আমরা সবাই বিস্মিত। একদিকে আমরা যেমন বিব্রত বোধ করছিলাম অন্যদিকে তেমনি এই গ্রাম্য কৃষকের আন্তরিকতায় অভিভূত হই। পরে জেনেছিলাম যে আমাদের আশ্রয়দানের অপরাধে আমরা চলে যাবার পর পাকসেনারা উক্ত কৃষকের বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।

 আমাদের আশ্রয়দাতা উক্ত কৃষক ও স্থানীয় অন্যান্য কতিপয় লোকের সহয়তায় পরদিন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে মতিনগর বিএসএফ ক্যাম্পে উপস্থিত হই। এখানেই ক্যাপ্টেন আবুর সাথে আমার প্রথম দেখা। তিনি পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।

 আমাদের প্রায় সাথে সাথে বিমান বাহিনীর প্রায় তিন শত জুনিয়র টেকনিশিয়ান ভারতে যায়। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিমান বাহিনীর যারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়েছিলেন তারা স্বেচ্ছায়