পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৫

আবদুল খালেক

 ঊনিশশত সত্তুরের মার্চ মাসে আমি সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল ছিলাম। অনেক আগে থেকেই দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গ/পূর্ব পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে রাখার ঘটনাবলী আমার চেতনায় আঘাত দিয়েছিল। লিয়াকত আলী খান, সরদার আবদুর রব নিশতার প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করবেন তা আমি মেনে নিতে পারিনি। রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ও খাজা নাজিম উদ্দিন যে সকল কথা বলেছেন, তাতে উর্দুভাষার প্রতি আমার বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেও আমার মনোভঙ্গির কোন পরিবর্তন ঘটাইনি, উর্দুভাষা শেখার কোন চেষ্টা করিনি যদিও পুলিশ বিভাগের উর্দুভাষার প্রচলন ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

 ১৯৫৬ সালের সংবিধানের সংখ্যাসাম্য নীতি এবং ১৯৫৮ সালের সামরিকবাদকে আমি মোটেও সমর্থন করিনি। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করাকে আমি নিছক বর্বরতা বলে গন্য করেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে প্রেক্ষাপটে যারা অবদান রেখেছেন তাদেরকে আমি আজও শ্রদ্ধা করি, ২১শে ফেব্রুয়ারী রক্তস্নাত পূর্ববঙ্গে যারা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তারা আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ।

 ১৯৬৯সালের সামরিক কর্তাদের আদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে পুলিশী তল্লাশি চালানো হয়। উক্ত তল্লাশির বিরোধিতা করে কিছু কথা বলার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ আমার উপর ক্ষেপে যায়। ঐ বছর ঢাকা বিভাগের ডিআইজি থাকাকালে প্রায় সময় সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটতো। প্রশাসনের সঙ্গে মতবিরোধ অনেক আগেও হয়েছিল। ১৯৫৪ ও ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আমি নিরপেক্ষ থেকে মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম। সে সময় আমার উপর কড়া নজর রাখা হতো। ১৯৬৯-এর শেষভাগে ঢাকার জনসাধারণ মওলানা মওদুদীকে পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিতে দেয়নি। গোলমালের দায়ে পুলিশ সুপার মামুন মাহমূদ (শহীদ) কে ময়মনসিংহে বদলী করা হয় এবং তার পদোন্নতি ছয় মাস পিছিয়ে দেয়া হয়। এই প্রসঙ্গে ঘোরতর আপত্তি জানালে মাস তিনেক পরে আমাকে ঢাকা থেকে সারদায় বদলী করা হয়। কিন্তু ঢাকার ঝামেলা থেকে সরে গিয়ে আমি খুব খুশি হই।

 ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল আমি লণ্ডনে বসে শুনতে পাই। পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তারা হতবাক। দু’চার জনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পরি যে, ফলাফল কার্যকর হতে দেয়া হবে না। দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কে এ কথা বলতে তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ ১৯৭১-এর জানুয়ারী মাস থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা উত্থাপন করতে শুরু করেছিল। ৭ই মার্চের ঘোষণা ও অসহযোগ আন্দোলনের ফলে আসন্ন সামরিক আঘাতের মোকাবেলা করার কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রস্তুতি আমাদের ছিল কিনা জানি না। আওয়ামী লীগ নেতারা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সংলাপের রাজনীতিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সামরিক কর্মকর্তারা বহু দেশে সংলাপের নামে রাজনীতিবিদদেরকে বোকা সাজিয়েছে এ খবর হয়তবা তাঁদের জানা ছিল না। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সারদা একাডেমিতে কর্মরত ও প্রশিক্ষণরত কয়েকশত পুলিশ খুব অস্থির হয়ে ওঠে। দেশের আসন্ন সামরিক পরিস্থিতিতে তারা জীবন দিয়ে-এই প্রতিশ্রুতি রেখে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ দল নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে যায়। একাডেমির স্টাফকে সে সময় স্থানীয় লোকজনদের গুলিবন্দুক বিষয়ক প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত করা হয়। সারদা একাডেমির খবর পেয়ে রাজশাহীতে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মামুন মাহমুদ (শহীদ)-এর কথা আগেই বলেছি তিনি তখন ময়মনসিংহ থেকে বদলী হয়ে রাজশাহীর ডিআইজি। পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ (শহীদ) মাত্র মাস দু’এক আগে সারদা থেকে বদলী হন। সারদা ও রাজশাহী পুলিশ লাইনে তখন পরিখা তৈরী করা হয় এবং পুলিশের নেতৃত্বে বিবিধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। রাস্তাঘাট কেটে সামরিক যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।