পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৯

দুর্বিপাকে রফিক দিশেহারা। হাইকমিশনে খন্দকার আসাদুজ্জামান, নূরুল কাদের খান ও আরো কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের কছে শুনতে পেলাম যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, আবদুল মান্নান ও কর্নেল ওসমানীকে বালিগঞ্জের একটি বাসায় থাকতে দেয়া হয়েছে। সেখানে কয়েকজন ভারতীয় তাদের দেখাশুনা করছেন। কামরুজ্জামান অন্যত্র থাকেন। তাদের সঙ্গে দেখা করে অনেক কথা জানতে চেয়েছি। সকলের মুখে একই কথা যে, তারা নিজ নিজ সিদ্ধান্তে ভিন্ন ভিন্ন পথে কলকাতায় এসেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেখতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ দেখাননি। বালিগঞ্জের সেই বাসস্থানে তাদের আর্থিক অনটন ও দুরবস্থা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। পাশেই মহিষের বাথান, দুর্গন্ধে টিকা যায় না। নিরাপত্তার অভাবে তারা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। শুধু কামরুজ্জামান ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন। কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন বলে তার জানাশুনা অনেক লোক ছিল। নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলীর পরিবারের কোন খবর নেই। পরিবার উদ্ধারের চিন্তায় তারা দিশেহারা। সারদার ইন্সপেক্টর গাজী গোলাম রহমানকে মনসুর আলীর পরিবার পাবনা জেলার কাজীপুর অঞ্চলে খুঁজে বের করে কলকাতায় আনার জন্য ঠিক করা হলো। পথের খরচ বাবদ একশত টাকা চাওয়া হলো। কিন্তু সে টাকা ১০/১২ দিনেও যোগাড় হয়নি।

 খন্দকার আসাদুজ্জামান, নূরুল কাদের ও আমি একসঙ্গে নেতাদের সঙ্গে দেখা করে প্রবাসী প্রশাসন গড়ে তোলার উপদেশ দেই। আমাদের মতে স্বাধীনতার ঘোষণা করে ঘরে বসে দিশেহারা হয়ে থাকলে চলবে না। আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সে জন্য চাই একটি প্রশাসন যন্ত্র। আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমাদেরকেই যথোচিত বিধিব্যবস্থা তৈরী করার ভার দেয়া হল। ইতিপূর্বে অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট পদে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী পদে তাজউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদে খন্দকার মোশতাক আহমদ, অর্থমন্ত্রী পদে মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র ও রিলিফ মন্ত্রী পদে কামরুজ্জামান অধিষ্ঠিত হন। ১৭ই এপ্রিলের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সরকারের কোন প্রশাসনিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল। মুজিব নগর সরকারের খসড়া প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার ভার আমাদেরকে দেয়া হয়। পাবনার ডেপুটি কমিশনার নূরুল কাদের খান এককালে বিমান বাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। তাছাড়া পাবানায় তিনি পাকবাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন। প্রশাসনিক খসড়া তৈরীতে নূরুল কাদেরের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশী। আসাদুজ্জামান, নূরুল কাদের ও আমি অফিসার্স ইনচার্জ পদবীতে প্রশাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। আমাদের কোন সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং ছিল না। কয়েকটি চেয়ার-টেবিলেই আমরা সকলে মিলেমিশে বসে কাজ করেছি। আর আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারাও একই সঙ্গে বসেছেন। কয়েক মাস পর যখন অন্যান্য অফিসার এসে যোগ দেন তখন আমরা সচিব, উপসচিব ইত্যাদি পদের সৃষ্টি করি। আমি স্বরাষ্ট্র সচিব এবং উপরন্তু আইজি পুলিশের দায়িত্বে ছিলাম। নূরুল কাদের খান পাবনা ট্রেজারির যে কয়েক কোটি টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সেই টাকাই ছিল মূলতঃ মুজিব নগর সরকারের আর্থিক সম্বল। আগরতলা অঞ্চলেও আমাদের কিছু টাক-পয়সার কড়াক্রান্তি হিসাব-নিকাশ দেয়া হয়। আসাদুজ্জামান অর্থ সচিব, নূরুল কাদের খান সংস্থাপন সচিবের কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নূরুল কাদের খান অভাবনীয় প্রতিভার পরিচয় দেন। সেক্টর, সাব-সেক্টর ইত্যাদি বেসামরিক প্রতিষ্ঠান মূখ্যতঃ তারই ধ্যান-ধারণা। ১৭০০ মাইল বর্ডারে এই সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ কিরূপ কঠিন হতে পারে তা হয়ত অনেকের ধারণায় আসবে না।

 বিভিন্ন সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধের অভিযান পরিচালনা করেছেন আমাদের সেক্টর কমাণ্ডারগণ। তাদের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র। কমাণ্ডারদের অধীন অফিসার, জোয়ান, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সমস্ত পেশার বাঙ্গালী বীর সন্তানেরা কাজ করেছেন। তাঁরা পাক-বাহিনীর ওপর হানা চালিয়েছেন। তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছেন। ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত করে সেখানে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। ১৭০০ মাইল স্থল সীমান্তে এই অভিযান একাধারে চালানো হয়। তাতে পাকিস্তানের সামারিক ব্যবস্থাপনা চরম বিপর্যয়ের