পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩১

কোন কোন অঞ্চলে আমাদের বিপ্লবধর্মী লোকজন সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক জোতদার শ্রেণীর মানুষকে হত্যা করেছে। সে সময় খবর পেতাম যে, যেহেতু রাশিয়া জাতিসংঘে আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছে সেহেতু রাশিয়াবিরোধী রাজনৈতিক মহল মুক্তি সংগ্রামকে রাশিয়ার চক্রান্ত বলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এই অভ্যন্তরীণ চক্রকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। নিয়মিত, অনিয়মিত এবং নিয়মবহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধারা বাংলার আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই ভারতীয় সাহায্য সহানুভূতিকে সম্বল করে আমরা এত অল্প সময়ে এত বড় বিজয় লাভে সমর্থ হয়েছি। কাজেই চিহ্নিত শত্রুদেরকে গুনে গুনে বাদ দিয়ে বাকী প্রতিটি বাঙ্গালী ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং বিজয় গৌরবের অংশীদার। এত অগণিত মানুষের ‘লিস্ট’ বানাবে আজ কে বা কারা?

 মুক্তিযুদ্ধের কতক দিক রয়েছে যে সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য রাখার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একাত্তরের ৭ই মার্চের ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার শর্তসম্পৃক্ত মর্মবাণী খুঁজে পেয়েছি কিন্তু ঘোষণাটি স্বাধীনতার ভাষায় লিপিবদ্ধ বলে মেনে নিতে পারিনি। অসহযোগ আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের নির্দেশে প্রশাসনিক পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এসেছিল তাতে আমি ভাবতে পারিনি যে সামরিক পরাজয় ছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে দেবে। বেসামরিক জনগোষ্ঠিকে একটি সুস্পষ্ট আসন্ন সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রে সংঘবদ্ধ করার কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী না থাকায় ২৫শে মার্চের হত্যাকাণ্ডের পর দিশেহারা ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ, ইপিআর ও বাঙ্গালী সেনারা কারো আদেশ ছাড়াই পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ২৫শে মার্চের অব্যবহিত পরেই আমাদের প্রতিটি গ্রামগঞ্জের শহরে বন্দরে ‘পশ্চিমা হটাও’ অভিযান গড়ে উঠে। ১৯৫২সালের একুশের পর থেকে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম লীগের বিরোধিতা করে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল আইয়ুব আমালের মাঝামাঝি সময়ে নেতৃত্বের অভাবে তা প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে এসেছিল। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান শেখ সাহেবকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শীর্ষমণি হিসেবে চিহ্নিত করে। তার অসাধারণ ত্যাগ, তিতিক্ষা ও জনদরদী মনমানসিকতার জন্য ১৯৭০সালের ইলেকশনে আওয়ামী লীগের যে বিজয় সূচিত হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কথা কেউ ভাবতে পারেনি। এ কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের শীর্ষমণি হিসেবে রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগকে মেনে নিতেই হবে।

 আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ কোন কেন্দ্রীয় আদেশে দেশত্যাগ করেছেন বলে জানা নেই। ২৫শে মার্চের পর তারা যখন কলকাতা বা আগরতলায় সমবেত হন তখন তাদের মধ্যে যে শূন্যতা পরিলক্ষিত হয় তাতে বুঝা গিয়েছে যে কোন পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁরা দেশত্যাগ করেছেন। কর্নেল ওসমানীও তাই করেছেন। এই পূর্বপরিকল্পনাহীনতার জন্য আমরাও বুঝতে পরিনি যে, আমাদেরকে কখন কি করতে হবে। এমনকি আগরতলায় যাঁরা পৌঁছেছিলেন তাঁদের কার্যকলাপের সঙ্গে কলকাতায় অবস্থানরত নেতৃবর্গের কোন সংযোগ ছিল না অনেকদিন। এজন্য ভিনদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের দুটি ধারা সূচিত হয়েছিল। মুজিব নগরে সরকারের প্রশাসন সংগঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধকে একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আওতায় আনা হয় এবং যথারিতি প্রশাসনিক বিধি নিষেধের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই সকল জটিল কাজ আমরা গুটিকতেক কর্মচারীরা সম্পন্ন করেছি, মাহবুব আলম চাষী (মরহুম), হাসান তৌফিক ইমাম, জহুর আহমদ চৌধুরী (মরহুম), মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ আগরতালায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক কাঠামো বানাবার প্রথম পর্বের সূচনা করেন। পরে তারা কলকাতা কেন্দ্রীক প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন।

 মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার কিছুটা অভাব ছিল। কিন্তু এই অভাবকে কোনক্রমে ঢেকে রাখার চেষ্টা প্রশাসন থেকে অতি সতর্কতার সাথে করা হয়। আপামর মুক্তিযোদ্ধারা যে অসীম সাহসিকতা, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ও মনোবল নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাতে কোন মহলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠাঁই পায়নি। পার্লামেণ্টের প্রায় সকল সদস্য ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশবাসীর কাছে তাঁদের দায় দায়িত্ব