পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩২

পালনে তারা সব সময় সতর্ক ছিলেন। কিন্তু এমন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চালাতে হয়েছিল যে শুধু তাঁদের প্রজ্ঞার ওপর সব কিছু ছেড়ে দেয়া সম্ভবপর ছিল না। সে জন্য আমাদের সামরিক অফিসারদের প্রজ্ঞাকেই সম্বল করে আমাদের এগুতে হয়েছে। আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল সেক্টর কমাণ্ডারদেরকে নিজ নিজ এবং বিস্তৃত মুক্তিবাহিনীর সব কিছু দেখাশুনা করা সম্ভবপর ছিল না। কাজেই সেক্টর কমাণ্ডারদেরকে নিজ নিজ পরিকল্পনানুসারে অনেকাংশে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে। পার্লমেণ্টের সদস্যবৃন্দ প্রশাসনে অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁদেরকে অনেক সময় পাশ কাটিয়ে এগুতে হয়েছে। তাতে কেউ কেউ অস্বস্তি বোধ করেছেন। এই পরিস্থিতি এড়াবার জন্য তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে বেসামরিক কম্যাণ্ড কাউন্সিল গঠন করেছিলাম। কার্যতঃ এই সকল কাউন্সিল যুদ্ধ চালনার কাজে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত ছিল না। যুদ্ধ সেক্টর কমাণ্ডারদের কলাকৌশল ও পরিকল্পনানুসারে পরিচালিত হয়েছে।

 জুলাই মাসের দিকে পার্লামেণ্টের সদস্যবৃন্দকে একত্রিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পারস্পরিক সমালোচনা, অভিযোগ ইত্যাদি যেন দানা বেঁধে উঠতে না পারে সে জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে এক প্রস্তাব পেশ করি। তিনি তাতে সম্মতি দেন। কিন্তু কোথায় কিভাবে এই সমাবেশ ঘটানো সম্ভবপর হবে তা ছিল ভাবনার বিষয়। ভারতীয় সরকারের সহায়তায় ও সৌজন্যে মেঘালয় ও দার্জিলিং-এর মধ্যবর্তী বাগডোগরা নামক এক নির্জন স্থানে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে পার্লামেণ্টের সদস্যবৃন্দ ও মন্ত্রী মহোদয়গণ দু’দিন বহু তর্ক-বিতর্কের সম্মুখীন হন। ফলে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার পথ সুগম হয়। বাগডোগরা সমাবেশকে মুজিবনগর সরকারের পার্লামেণ্টারী অধিবেশন বলা যেতে পারে। এই সমাবেশের খবর আমরা প্রচার করিনি।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোয় আমরা যখন আমাদের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলেছি তখন তাঁদেরকে সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। যে অন্যায়, অবিচার ও শোষণকে লক্ষ্য করে মুক্তিকামী বাঙ্গালীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল তার অবসান ঘটাতে হলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই যে আদর্শস্থানীয় তার ব্যতিক্রম কিছু বলার ছিল না। ধনতন্ত্রের কাঠামো ও ভিতকে দুর্বল করতে হলে জনসাধারণকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে হবে—এই ছিল আমাদের বাণী। এই দুর্গম পথের পাথেয় যে ত্যাগতিতিক্ষা তার নাম ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধ। ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন দান আর মা-বোনদের ইজ্জত হানি—এই আমাদের ত্যাগ তিতিক্ষা। ফসল হলো বাংলাদেশ।

 বাংলাদেশ স্বাধীন করব এ বিষয়ে আমাদের দৃঢ়প্রত্যয় ছিল। ‘৭১-এর নভেম্বর মাসে আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বা নীতিমালা এখান থেকেই তৈরী করে নিতে হবে। যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক ধ্বংসাবশেষের ওপর বিজয়ের গৌরব নিয়ে প্রশাসন চালাতে হলে যে প্রজ্ঞা, ধৈর্য্য ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন তা হয়ত রাজনৈতিক মহলে এককভাবে আশা করা সম্ভবপর হবে না এই ভেবে আমাদের উদ্যোগেই প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক মৌল কাঠামো তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত সরকারী, আধাসরকারী বা সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাসমূহ এবং কলকারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের ব্যাপারে এটা ধরে নিতে হবে যে তাঁরাও ছিলেন আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধা। এই ছিল আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। শুধু ব্যতিক্রম ছিল এইটুকু যে, যারা প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে দেশবাসীর কাছে জঘন্য শত্রুবলে চিহ্নিত হয়েছেন তাদের জন্য একটি স্ক্রীনিং কমিটি গঠন করা হয়। একজন বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য এবং সরকারের একজন সচিবকে নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির রায়কে সরকার চূড়ান্ত বলে মেনে নেবে। তারপর আরো কিছুসংখ্যক চিহ্নিত কর্মচারীর কাছ থেকে আনুগত্যের একটা শপথ নেয়া হবে এর বেশী কিছু নয়। আমাদের মতে এতেই দেশবাসী সন্তুষ্ট থাকবেন এবং প্রচলিত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তেমন কোন ওলট পালট হবে না।

 অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য বিবরণীর অভাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সুবিবেচিত না হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা ধারা প্রবাহ আমরা নির্ধারন করেছিলাম। অবাঙ্গালী মালিকানা শিল্প বা ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান