পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪১

উত্তরাঞ্চলের আলীগড়, মীরাট ও অন্যান্য স্থানের সাম্প্রদায়িকাতবিরোধী কাজে বিভিন্ন স্থানে জনসভা ও গণসংযোগ করি। এ সময় আমার নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দলকে নেপালে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি সরকারী নির্দেশ দেন। অপর দুই সদস্য ছিলেন শ্রী সুবোধ মিত্র ও আব্দুল মমিন তালুকদার এম, এন, এ। আমরা নেপাল যাওয়ার পূর্বে দিল্লীস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন হতে যে দুইজন ডিপ্লোমেট কে, এম সাহাবুদ্দিন এবং জনাব আমজাদুল হক ডিফেক্ট করেছিলেন তাঁদের সাথে যোগযোগ রেখে প্রায় দু’সপ্তাহ দিল্লীতে অবস্থান করি। এ সময় আমরা সর্বভারতীয় সংগ্রামী নেতা শ্রী আচার্য কৃপালনি এবং শ্রীমতি কৃপালনিসহ প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং আরো কয়েকজন বিপ্লবী—বীণাদাস (যিনি কলকাতার কনভোকেশনে গভর্নরকে গুলি ছুড়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আন্দামান হতে ফিরেছিলেন), শ্রী পান্নালাল দাসগুপ্ত ও শ্রী অমর সাহার সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা করে অনেক তথ্য ও মূল্যবান উপদেশ লাভ করি।

 এরপর আমরা নেপাল যাই। নেপাল তখন ছিল পাকিস্তানের খুব ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী রাষ্ট্র। সৌভাগ্যের বিষয় এই সময় কাঠমুণ্ডুতে তিনজন পাকিস্তানী কূটনীতিকের মধ্যে দুজনই বাঙ্গালী। জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সি,এস পি, এবং জনাব মোখলেছউদ্দিন সি,এস, পি ছিলেন। সচিবালয়ের একজন প্রবীন লোক ছিলেন তিনিও ছিলেন ভোলার অধিবাসী। এই সফরে আমরা নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ঋষিকেশ সাহা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী থাপা ও অন্যান্য বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগযোগ করি। তাঁরা সকলেই ““বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি”“নাম দিয়ে বাস্তুহারাদের সাহায্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেন। তাঁরা কয়েকটি ছাত্র-যুব সমাবেশের এবং একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান নেপালের রাজার পিতা শ্রী বীরেন্দ্র তখন জীবিত ছিলেন। বর্তমান রাজার আপন মামা ছিলেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও জাতিসংঘে নেপালের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী ঋষিকেশ সাহা। তাঁদের মাধ্যমে আমরা রাজদরবারে মুজিবনগর সরকারের ছবি ও কাগজপত্র প্রদান করি।

 নেপাল হতে প্রত্যাবর্তন করে আবার ১নং বালিগঞ্জে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে যোগদান করি। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত উক্ত কাজেই নিয়োজিত ছিলাম। ১৬ই ডিসেম্বর-এর পরে আমি আগরতলা হয়ে নোয়াখালী চলে যাই। ইতিপূর্বে ৬ই ডিসেম্বর হতেই নোয়াখালী হানাদারমুক্ত হতে থাকে। কাজেই আগরতলা, উদয়পুর এবং বেলোনিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার শরণার্থী ও প্রায় অধিকাংশ বাস্তুহারা এবং এম পি এ, এম এন এ ও অন্যান্য প্রায় সব নেতৃবৃন্দ এবং তাদের পরিবার-পরিবর্গ নোয়াখালী প্রত্যাবর্তন করেন। এমনকি আমার দুই ছেলেও তখন নোয়াখালীতে। কাজেই আমার স্ত্রী ও পাঁচ কন্যা শুধু আমার অপেক্ষায় উদয়পুরে অধীর আগ্রহে এবং উদ্বিগ্ন হয়ে বসেছিল।

 ইতিপূর্বে পূর্বঞ্চলের চেয়ারম্যান আমাকে সমগ্র নোয়াখালী (ফেনী ও লক্ষীপুরসহ) জেলার প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং আমার মন্ত্রীসভার যোগদানের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি উক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম।

 এখানে অত্যন্ত গর্বের সাথে উল্লেখ করতে পারি যে নোয়াখালী জেলা হানাদারমুক্ত হবার ও আমাদের প্রশাসনিক দায়িত্বে নেয়ার পরে কোন স্থানে কোন হত্যাকাণ্ড বা লুটতরাজ অথবা রাহাজানি হয়নি। এমনকি ইতিপূর্বে যুদ্ধ চলার সময়েও মুক্তিযোদ্ধারা যাদের হত্যা করেছিলো তাদেরও কোন মালামাল বা ঘরবাড়ী লুটপাট করেনি। আমি মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী এবং শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন বাহিনীকে নোয়াখালী জেলা স্কুল, হরিনারায়ণপুর স্কুল ও অন্যান্য স্থানে অস্ত্রশস্ত্রসহ শান্তিপূর্নভাবে অবস্থানের নির্দেশ দেই। ফেনী, লক্ষীপুর, রামগতি, কোম্পানীগঞ্জসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে ৪/৫ হাজার নগদ টাকা এবং নোয়াখালী সেণ্ট্রাল স্টোরে রক্ষিত কাপড়, কম্বল, চাউল-গম-ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করি। বিশেষ করে ডেলটা জুট মিলের ও দোস্ত মোহাম্মদ টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চাল সরবরাহ করি। সৌভাগ্যের বিষয় রাজাকার তহবিলে গচ্ছিত প্রায় ৮০ লাখ টাকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এবং ছাত্র শ্রমিক ও বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃবৃন্দের তত্ত্ববধানে বিলি