পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
88

যে অবস্থা ঠিক আছে। আমি আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট খবর আছে শেখ মুজিব ভালোই আছেন। এই সাক্ষাৎকারে লর্ড হিউমকে আমি জানাই, আমার শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। তিনি তাতে কোন আপত্তি করেননি। সেদিকে থেকে এটা অত্যন্ত সাফল্যজনক সাক্ষাৎকার ছিল। সেদিনই আমি চারটার সময় বিবিসিতে যাই। মিঃ ট্টার গিল সেখানে আমার একটা একক সক্ষাৎকার গ্রহন করেন। এই সাক্ষাৎকারে আমি পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করি। বিবিসিতে কর্মরত দুজনবাঙ্গালী সিরাজুর রহমান এবং শ্যামল লোধ আমার বিবৃতি নেন এবং প্রচার করেন।

 আমি বি, বি, সি -তে বিবৃতি দিয়ে বের হবার সময় পাকিস্তানী হাইকমিশনের মিঃ মহিউদ্দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কি করবেন। আমি তাঁকে বলি, আমি যথাসময়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব। কেননা তখন ও মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। এ অবস্তায় আমার পক্ষে এক সরকারী কর্মচারীকে সেই মুহুর্তে পদত্যাগ করতে বলা উচিত হোত না। পরে অবশ্য আমরা মিঃ মহিউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে বলি এবং তিনি তা করেন।

 আমি যে জায়গায় থাকতাম সেখানে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বার বার টেলিফোন করে আমাকে হাইকমিশনারের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তা প্রত্যাখান করি। অতঃপর আমি বাসা পাল্টাবার সিদ্ধান্ত নিই। কয়েকদিন পরে গোছগাছ করে যখন আমি রওয়ানা হচ্ছি ঠিক তখনই একটা টেলিফোন আসে। জানতে পারি টেলিফোনটি কলকাতা থেকে করা হয়েছে এবং অপরাপর কথা বলছেন টাংগাইল থেকে সংসদ সদস্য জনাব আব্দুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। এই টেলিফোন সরকার গঠনের কয়েকদিন আগে আসে। তাঁরা আমাকে জানান যে, তাঁরা আমার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন এবং তাঁরা চান যে, সরকার গঠনের পর আমি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করি।

 অস্থায়ী বাসস্তানে যাবার পর আমি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে একটি টেলিফোন পাই। কিভাবে তাঁরা আমার নতুন ঠিকানার খবর জানলো ঠিক বুঝতে পারিনি। তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করে জানান যে, পাকিস্তান সরকার আমাকে অপহরণ করার জন্য কিছু পাকিস্তানী লোক নিয়োগ করেছে এবং আমাকে অনুরোধ করেন অত্যন্ত সতর্কভাবে চলাফেরা করতে। তাঁরা অরো জনান সরকারী পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে যুক্তরাজ্যে থাকাকাল আমারি জন্য ছদ্মবেশী কর্মচারী দ্বারা নিরাপত্তার ব্যবস্তা করা হবে। তাঁরা বিশেষভাবে চলাফেরার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করে দেন এবং ভূগর্ভ রেলে ভ্রমন করতে বারণ করেন। কেননা এগুলি বিদ্যুৎ চালিত এবং ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার সম্ভাবনা বেশী, বাসে চলা অধিক নিরাপদ এবং পায়ে হেঁটে চলা আরো নিরাপদ। কারন এতে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের পক্ষে চোখ রাখা সহজ। তারা বলেন যে, যদিও সবসময় আমার ওপর তাদের নজর থাকবে তবু যে কোন বিপদে একটি বিশেষ টেলিফোন নাম্বারে যেন যোগাযোগ করি। সবশেষে তারা বলেন যে, এইসব নিরাপত্তার ব্যবস্তা গ্রহন করা হচ্ছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থন হিসেবে নয়। তারা চান যে, যুক্তরাজ্যের মাটিতে এমন কিছু ঘটুক যাতে যুক্তরাজ্যে সরকারের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। এই ঘটনার কিছু পরে বৃটেনে বসবাসরত বাঙ্গালীরা কাভেনট্রিতে একটি সভার আয়োজন করে। প্রকৃতপক্ষে এই অনুষ্ঠানে যাবার আমার খুব একটা উৎসাহ ছিল না। কারণ, অন্তর্দ্বন্দ ও কলহ এত বেশী হতো যে আমি খুবই বিমর্ষ বোধ করতাম। এ ছাড়া আমি অনুভব করছিলাম যে আমার কোন আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা ও ছিল না। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই জনাব রকিবউদ্দিন আমাকে মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপত্রটি দেন এবং আমি কভেনট্রিতে উপস্তিত হই। সভায় তুমুল হট্টগোল চলছিল। আমরা বেগম লুলু বিলকিস বানুকে অনুষ্ঠানের সভাপতি করে কাজ শুরু করি। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে এই সভা পরিচালনা করেন। এই অনুষ্ঠান চলাকালে জনাব রকিব আমার নিয়াগপত্রটি পড়ে শোনান। কিন্তু আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল থাকায় আমি মর্মাহত অবস্তায় হল ত্যাগ করতে উদ্যত হই। এ সময় জনাব মিনহাজ উদ্দিন নামে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন যে বহু কলহ হয়েছে, এই কলহে আমাদের অনেক ক্ষতি ও হয়েছে। আমরা আর কলহ চাই না। আপনি যাবেন না। এরপর আরো আধঘণ্টা ধরে আলাপ আলোচনা