পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪৫

হয় এবং গউস খান প্রস্তাব করেন যে, পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি ষ্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হোক। এর নামকরণ করা হয় ‘ষ্টিয়ারিং কমিটি অফ পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’। আমি সভাপতির পদ গ্রহন করতে দ্বিধাবোধ করি। কারন আমার ভয় ছিল এই সংগঠন আবার ভেঙ্গে যাবে। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম, আমার মুল দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ব জনমত গঠন করা এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারর ওপর চাপ সৃষ্টি করা। যাহোক শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, ষ্টিয়ারিং কমিটি তার কর্মকাণ্ড চালাবে আমার উপদেশ মতো।

 ১১ নং গোরিং স্ত্রীটে এই কমিটির জন্য অফিস নেয়া হয়। অফিস ঘরটি ছিল জনাব হারুনুর রশীদের। তাঁর পাটের ব্যবসা ছিল। কমিটির সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান, মিঃ কবীর চৌধুরী, আর মিঃ আজিজুল হক ভূইয়া ছিলেন আহ্বায়ক। এই সংগঠনের মুল লক্ষ নির্ধারিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন এবং অস্ত্র সরবরাহ ও সাংগঠনিক কাজের জন্য মূলতঃ বাঙ্গালীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ। পরে যখন দেখা গেল অস্ত্র সরবরাহে নানা বাধা তখন আর অর্থ সংগ্রহের জন্য তেমন প্রচারণা চালানো হয়নি।

 মুজিব নগর সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাষ্টি গঠন করা হয়। এই বোর্ডের সদস্য ছিলেন মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, প্রাক্তন মন্ত্রী মিঃ ষ্টোন হাউস এবং আমি। এ কমিটিতে কয়েকজন বাঙ্গালীর সদস্য হবার কথা ছিল। কিন্তু কোন কোন বাঙ্গালী নিয়ে ফাণ্ড হবে ঠিক করতে না পারায় আপাতত এই তিনজনকে নিয়ে বোর্ড গঠিত হয়। পরে আরো নেবার কথা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং বোর্ডের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।

 পাকিস্তানী দূতাবাস এই অর্থ সংগ্রহ অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাতে থাকে এবং বহুলাংশে সফল হয়। কোন ব্যাংকই একাউণ্ট খুলতে দিতে রাজী হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত হ্যামব্রোজ ব্যাংক রাজী হয় এবং সেখানে এ্যাকাউণ্ট খোলা হয়।

 কিন্তু পাকিস্তান হাইকমিশন চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে যার ফলে হঠাৎ করে একদিন হ্যামব্রোজ ব্যাংক আমাদের জানায় তারা এই এ্যাকউণ্ট চালাতে দেবে না এবং আমাদের সমুদয় অর্থ উঠিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ বলে কোন দেশ নেই। অথচ ফাণ্ডের নাম বাংলাদেশ ফাণ্ড। এই ঘটনাটি ঘটে জুন মাসে। তখন আমাদের এ্যাকাউণ্টে এক লক্ষ পাউণ্ড সংগৃহীত হয়েছিল। ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে আমরা অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হই এবং বিচলিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন জন স্টোন হাউস (এমপি) এবং তিনি ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাংকে এ্যাকাউণ্ট খোলার ব্যবস্থা করে দেন। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, এই ব্যাংক পূর্বে আমাদের এ্যাকউণ্ট খুলতে দিতে রাজী হয়নি। অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে এমন ব্যবস্থ করা হয় যাতে করে সরাসরি ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া যায়। ইংলণ্ডের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন ব্যাক্তি সরাসরি ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারতেন। অর্থ সংগ্রহ এবং আন্দোলন পরিচালনার জন্য নানা প্রান্তে একশটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রথম থেকেই আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকি এবং কনসারভেটিভ পার্টির প্রফেসর জিনকিন’স-এর সাথে যোগযোগ করি। তিনি একজন প্রাক্তন আই, সি, এস অফিসার ছিলেন। কনসারভেটিভ পার্টির অফিসে একটি সভার আয়োজন করি এবং তাদের কাছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণ তুলে ধরি।

 লেবার পার্টির সদস্যদের সাথেও আমার যোগাযোগ হয়। তাঁরা আমাদের এই আন্দোলনের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁরা একটি সভার ব্যবস্থা করেন। এ সভা পার্লামেণ্ট ভবনেই অনুষ্ঠিত হয়। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ছিল আমাদের আন্দোলনের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা এবং স্বীকৃতির ইংগিত। মে মাসে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।