পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
left
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪৬

আমার আনুষ্ঠানিক কর্মের অংশ হিসেবে সে মাসেই নিউইয়র্ক যাই। ওখানকার বাঙ্গালী কূটনীতিক জনাব মাহমূদ আলীর নেতৃত্বে প্রায় দুশ বাঙ্গালী আমার সাথে বিমানবন্দরে মিলিত হয়। এই দৃশ্য অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিল। কারণ এতে করে আমাদের আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের লক্ষণ দেখা যায়।যেদিন আমি নিউইয়র্কে পৌঁছি আরো কয়েকজন বাঙ্গালী উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী যথা—জনাব এ, এম, এ মুহিত, জনাব খোরশেদ আলম, জনাব হারুন রশীদ এবং আরো অনেকে আমার সাথে দেখা করেন। তাঁদের সাথে আন্দোলনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়। জনাব মাহমূদ আলী বিভিন্ন দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন। এবং আমি তাদের সাথে মিলিত হই এবং প্রকৃত অবস্থা তাদের সামনে তুলে ধরি। একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত জনাব বারুদী যিনি খৃষ্টান ছিলেন, রোকেয়া হলের ঘটনা শুনে তিনি এতো বেশী আলোড়িত হয়েছিলেন যে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন যে, তিনি সৌদী বাদশাহকে সমস্ত কথা জানাবেন এবং সর্বতোভাবে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালাবেন।

 জাতিসংঘের বিভিন্ন কূটনৈতিক সদস্যের সঙ্গেও দেখা করি এবং বক্তব্য রাখি। জাতিসংঘের তৎকালীন অধিবেশনের সভাপতি নরওয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয়। আমরা প্রচারপত্র বিলি করি এবং বিভিন্ন সাংবাদিকে সঙ্গে মিলিত হই।

 জাতিসংঘের মহাসচিব উত্থাণ্টের সাথে দেখা করার চেষ্টা করি। তিনি আমাদের জানান যে তাঁর সাথে সরাসরি দেখা করা আমাদের বিপক্ষে যাবে। কেননা তিনি নীরবে আমাদের জন্য কাজ করে যেতে চান। দেখা করলে পাকিস্তানে চাপ প্রয়োগের সুযোগ অনেক বেশী থাকবে। তিনি আরো বলেন যে, এ সিদ্ধান্ত আমাদের কল্যাণের জন্য এবং আমাদের বক্তব্য শোনার জন্য তিনি জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পাঠান।

 আমি যখন ইংল্যাণ্ডের বাইরে যেতাম শেখ মান্নানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতাম। কারণ তিনি ইংল্যাণ্ডে থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। বৃটেনের বিভিন্ন জায়গায় আমরা সভা করি এবং আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারন করে।

 এরই মধ্যে ফ্রান্সের সাথে আমরা যোগাযোগ করি এপ্রিলের শেষের দিকে। আমি সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি। সেখানে থাকতে আমার একজনের সঙ্গে গুরুত্ব পূর্ণ যোগাযোগ হয়, তিনি হচ্ছেন মরিসাসের প্রধানমন্ত্রী জনাব সিউ সাগর রামগোলাম। তাঁকে আমি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ জানাই। বিভিন্ন অবস্থার কারণে তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি কিন্তু অন্য সব ধরনের সাহায্য তিনি আমাদের করেন। আমি প্যারিসে তাঁর সাথে একদিন আমাদের আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি তাঁর দেশের লণ্ডনস্থ দূতাবাসকে আমাদের সব ধরনের সাহয্য করার জন্য নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আমরা কিছু বাঙ্গালী ছাত্রকে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সে পাঠাই। আন্তর্জাতিক পার্লামেণ্টারী ইউনিয়নের সভায়ও আমরা প্রতিনিধি প্রেরণ করি।

 বৃটেনে অবস্থিত “সোস্যালিষ্ট ইণ্টারন্যাশনালের“সাধারণ সম্পাদক হ্যান্স ইয়ানিতশেক আমাদেরকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা এবং সাহায্য করেন। তিনি বলেন, আমার অফিস তোমাদেরই অফিস, তোমরা এটা সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পার। এখানে বলা উচিত যে, কিছুদিন আমরা এই প্রস্তাবের সদ্ব্যবহার করি।

 লণ্ডনে জার্মানীর প্রাক্তন চ্যান্সেলর উইলি ব্রাণ্টের সাথে আমি সাক্ষাৎ করি এবং তাঁকে জানাই যে কোন স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের পক্ষে অন্য কোন পথ সম্ভব নয়। তিনিও আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এখানে বলা যায় যে, যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমরা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল অভ্যর্থনা এবং সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছি। এর একটি কারণ হচ্ছে যে, বৃটেনের প্রেস আমাদের খবর এমনভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছিল যে, জনমত আমাদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল। জুন-জুলাইয়ের দিকে একটি গুঞ্জন ওঠে যে, আমাদের ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আমি অনুসন্ধান করে দেখি যে এ সংবাদ একেবারে ভিত্তিহীন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা