পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৪৭

এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। জুলাই মাসে বৃটেনে অবস্থিত বাঙ্গালীদের আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং জোরদার হয়ে ওঠে। আগষ্ট মাসের প্রথম তারিখে আমরা ট্রাফলগার্ড স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা করি। এটি ছিল লণ্ডনে অনুষ্ঠিত আমার জানামতে সাম্প্রতিক কালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ। প্রায় ৪০ হাজার লোক এই সমাবেশে উপস্থিত হন। এলাকার চারিদিকে সমস্ত বাড়ীঘরের ছাদে লোকজন ভর্তি হয়ে যায়। এই সভাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মহিউদ্দিন বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা ঘোষণা করেন।

 আগষ্ট মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকারের সম্মতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মিশন চালু হয়। ২৪নং পেমরিজ গার্ডেনে মিশনের অফিস খোলা হয় এবং এই ভবনটি ব্যবস্থা করেন ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। তিনি বিনা ভাড়ায় ভবনটি ব্যবস্থা করে দেন। আমরা শুধু পানি এবং গ্যাসের বিল দেবো এ ব্যবস্থা হয়। আগষ্টের শেষে রোদমে এই মিশনের কাজ শুরু করে। এই সময় ডঃ মোশারফ হোসেন জোয়ারদার-এর মাধ্যমে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলামামের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি অসুস্থাতর অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি সুবেদ আলী নাম নিয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এবং তিনি বৃটেনে এই ২৪নং প্রেমরিজ গার্ডেনে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের সমস্ত খরচ বহন করতেন। মিশন চালু হওয়ার পর আমি এর প্রধান হিসাবে যোগদান করি। বহির্বিশ্বে এটাই বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস।

 আমার বিদেশ ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে। আমার দায়িত্ব ছিল আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করা। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আন্দোলন বেশ শক্তিশালী আকার ধারণ করে।

 নেদারল্যাণ্ডেও একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিল। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব জহির উদ্দিন এবং আমীর আলী। জুন মাসের দিকে ঠিক হয় যে, আমি এ্যামষ্টেডামে যাবো। একদিন পূর্বেই হঠাৎ করে আমার বাসায় এ্যামষ্টেডামের টেলিভিশনের একটি দল উপস্থিত হয় এবং আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এতে আমাদের আন্দোলন ব্যাপক প্রচার লাভ করে। বলা যেতে পারে অন্য দেশ থেকে এসে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা আমাদের আন্দোলনকে এক ধরনের স্বীকৃতি প্রদানের সামিল।

 ডাচ পার্লামেণ্ট ভবনে বৈদেশিক বিষয়ক উপ-পরিষদে তিন ঘণ্টা আলোচনা করি। যাঁদের সঙ্গে আলোচনা হয় তাঁরা ছিলেন মিঃ টারবিক, জ্যাঁ প্রাংক, মোমেসত্যাগ, স্বাধীকার, ভ্যান উস্তেন। তাঁরা প্রায় সবাই বুঝতে পারেন কেন আমরা স্বাধীনতা দাবী করেছি। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং আমাদের বিজয় কামনা করেন। পার্লামেণ্টে আমাদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। আমাদের প্রেস কনফারেন্সটি অত্যন্ত সফল হয়েছিল। ডাচ সরকার আমাদের পক্ষে একটি বিবৃতি দান করেন এবং সরাসরিভাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠান। ডেনমার্কেও আমাদের সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। আগষ্ট মাসের দিকে আমরা সেখানে যাই। ডেনিশ পার্লামেণ্টের স্পীকারের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং আমাদের বক্তব্য পেশ করি। তিনি আমাদের সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করেন। এখানে এক ভদ্রমহিলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তাঁর নাম কিনটেন ওয়াট বার্গে। তাঁর গৃহ আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। তিনি তার বাসায় একটি সম্বর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে অনেক বাঙ্গালীও উপস্থিত হন। ওই ভদ্রমহিলাকে কেন্দ্র করে কমিটি গঠন করা হয়। আমরা সেখানেও ব্যাপক প্রচারকার্যে সফল হই। ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস, এ, ডাম-এর সঙ্গেও দেখা করি। আরেকজন যিনি আমাদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন তিনি ছিলেন ‘পলিটিকেন’ পত্রিকার সম্পাদক জন ডেনষ্ট্যাম্প। তিনি শুধু আমাদের পক্ষে পত্রিকাতেই লিখেননি, বরং সাথে সাথে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচারের ব্যবস্থাও করেন। ডেনিশ টিভি সাক্ষাৎকারের সময় আমাদের আন্দোলনের পক্ষে একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ঘটে। যিনি আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন, তিনি সাক্ষাৎকার শুরু হবার পূর্বেই আমাকে জানান যে, তিনি খবর পেয়েছেন একটি ডেনিশ কোম্পানী পাকিস্তান সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রয় করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন যে, আমাকে এমনভাবে প্রশ্ন করা হবে যাতে আমি এই বিষয়টি উত্থাপন করতে পারি। সাক্ষাৎকার শুরু হবার সাথে সাথে আমি এই তথ্যটি জানাতে সক্ষম হই এবং সমস্ত বিষয়টির প্রতিবাদ ও