পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫২

পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী সাধারণ মানুষের আশা-আকঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। আর তা যদি না করা হয় তাহলে সামরিক শাসনের বেড়াজাল থেকে পাকিস্তান কোন দিন মুক্তি পাবে না। আমার কথায় প্রচ্ছন্ন এই ইঙ্গিত ছিল যে, শাসনতন্ত্র রচনায় আমাদের সাথে সহযোগিতা না করলে ভূট্টোর কোন লাভ হবে না। বরং সামরিক জান্তারই বেশী সুবিধা হবে। আমার কথার জবাবে ভুট্টো একটি তাৎপর্যপূর্ন উক্তি করেন। তিনি বলেন, ‘ডোণ্ট ফরগেট আমিরুল ইসলাম, দ্যাট আই গট লারজেষ্ট নাম্বার অব ভোটস ইন দি ক্যানটনমেণ্ট। এই একটি কথায় বুঝে নিতে আমার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, পাকিস্তানের সামরিক জন্তার সাথে ভুট্টোর কি সম্পর্ক রয়েছে। অন্যান্য দিনের মত ভুট্টো সেদিন হোটেলে না গিয়ে তখনকার গভর্নর হাউসে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি তাকে সেখানে নামিয়ে দেয়ার সময় দেখলাম, সিঁড়ির নীচে গভর্নরের এ ডি সি ভুট্টোর জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি ভুট্টোকে বলেন জেনারেল আকবর ফোনে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

 আমার মনে হয় এ দুটো ঘটনা আলোচনার ভবিষ্যৎকে সন্দিহান করে তোলে। ফিরে এসে আমি বঙ্গবন্ধুকে এই ঘটনা জানাই। ৩১শে জানুয়ারী ভুট্টো সদলবলে ঢাকা ত্যাগ করেন। যাবার কালে ভুট্টো বলে যান আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র তৈরী করা হবে। কিন্তু করাচী ফিরে ভুট্টোর সুর বদলে যায়। তিনি বলতে থাকেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার এখতিয়ার আওয়ামী লীগের নেই। আসন্ন গনপরিষদের অধিবেশনে তিনি যোগ দেবেন না এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অন্য কাউকে যোগ দিতে দেবেন না। পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তিনি জেনারেলদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। বিভিন্ন ঘটনাবলী থেকে সম্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সামরিক জান্তার জেনারেলদের ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন সদিচ্ছা নেই। কেন না তারা বুঝতে পারে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে সামরিক জান্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। আর এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জেনারেলদের সাথে গোপনে ভুট্টোও হাত মিলান।

 ফেব্রুয়ারী মাসে আমাদের দ্বিতীয় দফা ও শেষ প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র রচনা। পহেলা মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শাসনতন্ত্র রচনাকারী কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। এই বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সরফরাজসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের প্রণীত খসড়া শাসনতন্ত্র কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন লাভ করে। এই ব্যাপারে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের ওপর ন্যস্ত করেন।

 সকালের বৈঠকের পর হোটেল পূর্বাণীতে বিকেলের বৈঠকের স্থান ধার্য করা হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সময় বেল ১টা ৫মিনিটে প্রেসিডেণ্ট ইয়হিয়া খান পাকিস্তান বেতারে প্রচারিত এক বিবৃতিতে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বাংলার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করার জন্য এই একটি ঘোষণাই যথেষ্ট ছিল। ঢাকা শহরের সকল শ্রেণীর মানুষ এই ঘোষণার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। জনতার জোয়ারে ভেসে যায় ঢাকার প্রতিটি অলিগলি রাজপথ। মিছিলকারী জনতার হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও লোহার রড। জনতার মুখে একটি শ্লোগানই শোনা যায় ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশকে স্বাধীন কর’, ‘৬দফা, না এক দফা, এক দফা এক দফা। সারা শহর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল পল্টন ময়দানে এসে জমায়েত হয়। পল্টনের সভায় বক্তৃতা করেন তোফায়েল আহমেদ, নুরে আলম সিদ্দিকী আ, স, ম, আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আবদুল মান্নান প্রমুখ। এই সভায় ডঃ কামাল হোসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। জনতা সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি কামনা করছিল। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ও সংসদ সদস্যরা হোটেল পূর্বর্ণীতে উপস্থিত হয়েছেন।

 বেলা সাড়ে চারটায় হোটেলে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে পুর্ন হরতাল পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আগামী ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে এক জনসভায় তিনি ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ঘোষণা