২৪শে মার্চ বিকেল থেকেই বঙ্গবন্ধু সকলকে ঢাকা ছেড়ে যাবার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু তার পেছনের ঘরে প্রায় প্রত্যেকের সাথে এক মিনিট করে কথা বলেন। অনেক সময় ভিড়ের মধ্যে বাথরুমেও কারো করো সাথে তিনি কথা বলেন।
২৫শে মার্চ তারিখেও এ ধরনের শলাপরামর্শ চলে। বঙ্গবন্ধু একে একে সকলকে বিদায় দিচ্ছেন। বিকেল থেকেই যেন ৩২ নাম্বারের বাড়ীতে থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। বিকেল প্রায় ৪টায় আমার বন্ধু তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেণ্ট জনাব রিজভী বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কথা বলার সময় আছে কিনা। সময় থাকলে তার সাথে চা খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। রিজভীর বাসা বঙ্গবন্ধুর বাড়ী থেকে ২০০ গজ দূরে। আমি রিজভীর সাথে তার বাসায় গেলাম। রিজভী আমাকে বলেন, অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এদেশ বসবাসের কোন যোগ্য থাকবে না। তিনি এখনই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সেনানিবাসে তার ভগ্নিপতির বাসায় চলে যাচ্ছেন। রিজভী তার পাঠান দারোয়ানের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, আমি কোন সময় গেলে যেন আমাকে থাকার আশ্রয় দেয়া হয়। তিনি বলেন, ইচ্ছা করলে আমি তার বাড়ী ব্যবহার করতে পারি। পেছনের একটি দরজা দেখিয়ে বলেন, বিপদের সময় পলায়নের রাস্তা রয়েছে। পরে জেনেছিলাম শহিদুল্লাহ কায়সার কিছুদিন এই বাড়ীতে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফিরে এসে তাড়াতাড়ি হাতের কাজগুলো শেষ করি। রিজভীর কাছে শোনা বক্তব্য এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধুকে জানাই। বঙ্গবন্ধু শুনে গম্ভীর হয়ে যান। এর ক’দিন পূর্বে এরকম একটি আত্মগোপনের কথা নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মগোপনের জন্য চাপ দেই। তিনি আত্মগোপন করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আত্মগোপনের জন্য তিনি পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলে আসছেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না।
বঙ্গন্ধু একদিন তাঁর বেডরুমে হাইকম্যাণ্ডের বৈঠকের সময় তাজউদ্দিন আহমদ ও আমাকে ডাকেন। আমি আমারসহ হুইপ আবদুল মান্নানকে নিয়ে সেখানে যাই। বৈঠকে আত্মগোপনের জন্য আমরা সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুকে চাপ দেই। তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়। আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।
২৫শে মার্চ বিকেলে আমার আবর ইচ্ছা হলো আত্মগোপন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আনুরোধ জানাই। মনে মনে ঠিক করলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন আসলে সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় শেষ অনুরোধ জানাবো। তাঁরা দু’জন অন্য কাজে বাইরে ছিলেন। আমি জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর শেষ বক্তব্যের খসড়া তৈরী করতে ব্যস্ত। আমার খসড়া প্রস্তুত হলো। বঙ্গবন্ধু একটু দেখে ঠিক করে দেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সামনে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
আমি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে বেরিয়ে পাশে বদরুন্নেছা আহমদের বাসায় খোঁজ নিতে যাই। নুরুদ্দিন ভাই বলেন, সেনানিবাস থেকে শিগগিরই ট্যাংক বেরিয়ে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো জনতার ওপর আক্রমণ শুরু হবে। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে ফিরে এসে দেখি তিনি ওপরে চলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আবার বেরিয়ে আসি। আমি এখনো আশা করছি তাজউদ্দিন আহমদ ও কামাল হোসেনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ আলোচনা করবো। তাজউদ্দিন ভাইয়ের বাড়ীতে গিয়ে দেখি নূরজাহান মোর্শদ এম,পি বসে আছেন। বাড়ীর ভেতরে তাজউদ্দিন ভাই জোরে জোরে ভাবীর সাথে কথা বলছেন। কথা বুঝলাম তাজউদ্দিন ভাইয়ের মন খারাপ। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু না বলেই এই বাড়ী ত্যাগ করি। উদ্দেশ্য কামাল হোসেনের সাথে দেখা করা। গাড়ীতে নূরজাহান মোর্শেদকে নিয়ে নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তার বাসায় নামিয়ে দিতে যেয়ে তাকে বল্লাম, আজ রাতটা বড় খারাপ। তাকে নামিয়ে আমার বাসায় আসার পথে দেখি পাক সৈন্যরা বেতার ভবন দখল করে নিয়েছে।