পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৫৮

 তাজউদ্দিন ভাই গত কিছুদিন যাবৎ আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা বলছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে রাইফেল ট্রেনিং নিয়ে নিয়েছেন। আরহাম সিদ্দিকী তাকে এই রাইফেল যোগাড় করে দেন। কিন্তু এই রাইফেল পরবর্তীকালে আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রাইফেল বেশী দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

 সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো এই এলাকায় পাক সৈন্য এসে যাবে। পুরাতন ঢাকার একটা বাড়ীতে সকলের একত্রিত হবার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবন থেকে বাইরে আসতে রাজী না হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ছেড়ে না যাবার সিদ্ধান্তে নেতাদের মন ভেঙ্গে যায়। তাজউদ্দিন আহমদ ভগ্নমনোরথ আবস্থায় বাড়ীতে বসে ছিলেন। তিনি নিজেকে এক রকম ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। আঘাত হানার পূর্বেই আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। এরপর ভাবলাম, ১লা মার্চ থেকে তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হোসেন ও আমি একত্রে কাজ করেছি। এই ৩ জনকে যে কোন মূল্যে একত্রে থাকতে হবে। ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি এলে ডঃ কামাল গাড়ী থামাতে বলেন। তিনি বলেন, সকলে এক বাড়ীতে না থেকে আমি এখানে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকে যাই।

 আমার চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধা দিতে পারলাম না। তবে মনে মনে খুবই বিরক্ত হলাম। কামাল হোসেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার ধরনটা মেনে নিতে পারলাম না। তবুও কামাল হোসেন গাড়ী থেকে নেমে গেলেন। কথা রইলো পরদিন সুযোগ পেলেই তিনি মুসা সাহেবের বাড়ীতে যাবেন। আমরাও সেখানে যাব, না হয় যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু এটা আর হয়ে ওঠেনি। ডঃ কামাল মুসা সাহেবের বাড়ী যেতে পারেননি, আর আমরাও পারিনি ডঃ কামালের সাথে যোগাযোগ করতে। পরবর্তীকালে তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নির্যাতিত হন পাকিস্তানী কারাগারে। আর আমরা বঞ্চিত হই তার সুযোগ্য নেতৃত্ব থেকে। ডঃ কামালের সেদিনের একক সিদ্ধান্ত আজও আমাকে পীড়া দেয়। যদ্দিন তিনি পাকিস্তানী কারাগারে থেকে ফিরে না এসেছেন, তদ্দিন নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়েছে। কেন সেদিন জোরে বাধা দিতে পারিনি।

 ইতিমধ্যে ধানমণ্ডির বিদ্যুৎ চলে গেলো। রাস্তা জনমানব শূন্য। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দুই একটা গাড়ী মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর মত দেখা যায়। কালবিলম্ব না করে লালমাটিয়ায় রেলওয়ের এককালের চীফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ীর কাছে গিয়ে দু’জন নেমে গেলাম। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে মুসা সাহেবের বাড়ী চলে গেলো।

 গফুর সাহেব আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। আমরা তাকে পূর্বে কোন খবর দেইনি। তবুও তিনি আমাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করলেন। আমরা বাড়ীতে ঢুকার ৫/৭মিনিটের মধ্যেই এক প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত ঢাকা শহর কেঁপে উঠলো। পরে জেনেছি এটা ছিল আঘাত শুরু করার সংকেত।

 শুরু হলো চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ার। অবস্থা জানতে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই বাড়ীর ছাদে যাই। পাক বাহিনীর ব্যপক হামলার মাঝে আমাদের ছেলেদের ৩০৩রাইফেলের বিচ্ছিন্ন শব্দ। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পাই। পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের কয়েকটি বাড়ি থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা গেলো। আমরা মোহাম্মদপুর এলাকার কাছাকাছি ছিলাম। তবে একদিক থেকে আমাদের বাড়ী নিরাপদ মনে হলো। কেননা অবাঙ্গালী অধ্যুষিত মোহম্মদপুর এলাকায় পাক বাহিনী কোন হামলা করবে না। আক্রমণের ব্যাপকতা ও আকস্মিকতায় একেবারে থ’ হয়ে গেছি।

 আমাদের ওপর হামলা হবে একথা জানতাম। সেটা হবে রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও কর্মীদের ওপর। কিন্তু আধুনিক সমর সজ্জিত পাক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীর ওপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা ভাবতে পারিনি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের নজির আর কোথাও দেখিনি। গফুর সাহেবের বাড়ীর অসম্পূর্ণ ছাদের ইটসুরকীর