পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬০

 এই অবস্থায় তাজউদ্দিন ভাই এর নাম মহম্মদ আলী আর আমার নাম রহমত আলী ঠিক করে নেই। সার্চ হলে বলা হবে মহম্মদ আলী চাঁদপুরে গফুর সাহেবের ঠিকাদারীর কাজ তদারকি করেন। আর আমার বাড়ী পাবনা, আমি গৃহস্বামীর ভাই এর ছেলে। ঢাকায় বেড়াতে এসেছি।

 ২৬শে মার্চ সারাদিন গফুর সাহেবের বাড়ীতে আটক থাকি। বাইরে কার্ফু। চারদিকে মিলিটারী জীপ টহল দিচ্ছে। ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজের উপর সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে। উপরে সার্চ লাইটের মতো কি যেন একটা বসানো হয়েছে। এটা দেখে মনে হয় একটা যুদ্ধের ছাউনী। কলেজের ছাদের ওপরে মেশিনগান তাক করে ওরা কণ্ট্রোল রুম থেকে সকল এলাকা পাহারা দিচ্ছে। আমরা যে বাড়ীতে আছি সে বাড়ী থেকে সব দেখা যাচ্ছে। আমরা আশংকা করছি যে কোন মুহূর্তে বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু হতে পারে।

 পরদিন ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলাম, কার্ফু ও গোলাগুলির মধ্যেও সাধারণ মানুষের গতি অব্যাহত রয়েছে। সামনে রাজপথ দিয়ে লোকজনের চলাচল নেই। কিন্তু ভেতরের রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। ছোট ছোট ছাপড়া দোকানগুলো ঝাঁপ উঠিয়ে সওদা বিক্রয় করছে। কাজের মেয়েরা কলসী দিয়ে পানি নিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলাম, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গেলে আমার চলাচলেও কোন অসুবিধা হবে না।

 আমি একাই বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ি। যে কোনভাবে সাত মসজিদ রোড পার হতে হবে। আমার অবস্থান থেকে সাত মসজিদ রোড বেশ দূরে। আমার খুবই পরিচিত কুষ্টিয়ার আতাউল হক সপরিবারে সাত মসজিদ রোডের কাছাকাছি থাকেন। গলি দিয়ে পার হচ্ছি। পথে একজন মৌলানাকে পেলাম। এমনিতেই তার সাথে কথা বলি। তিনি লালমাটিয়ার পুরাতন অধিবাসী। মৌলানা সাহেব আতউল হককে চিনেন। তার সাহায্যে আতাউল হকের বাড়ীতে পৌঁছি। মৌলানাকে বললাম, আমি হক সাহেবের আত্মীয়, পাবনা থেকে এসেছি। ওরা আমাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। পরে জড়িয়ে ধরে বাড়ীর ভেতর নিয়ে গেল।

 মৌলানাকে ঐ বাড়ীতে আমার আত্মীয় মহম্মদ আলী আছেন, তাকে নিয়ে আসার জন্য বললাম। কিছুক্ষণ পর মহম্মদ আলী এসে হাজির হলেন।

 হক সাহেবের বাড়ীতে আমাদের নাশতা তৈরী করতে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে আমি আবার বেরিয়ে পড়েছি। বিভিন্ন বাড়ীর পেছনের অলিগলি দিয়ে পথ চলছি। আমার আশংকা হচ্ছিল এই বাড়ী থেকে বেরোতে না পারলে আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন কোন স্থানে হামাগুড়ি দিয়ে সাত মসজিদ রোডে পৌঁছার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে একটি মিলিটারী জীপ এই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তায় ঢুকেই ওরা এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ে। আমি একটি বাড়ির পাশে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। জীপটি ফিরে যেতেই আমি আতাউল হকের বাড়ীতে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর এ ধরনের গোলাগুলি চরম আকার ধারণ করে। কোথাও আগুন জ্বলছে। ভয়ার্ত মানুষের আর্তচীৎকারে পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

 আতাউল হকের ঘরের বেড়া ও চাল টিন দিয়ে তৈরী। টিনের বেড়া ফুটো করে গুলী যে কোন একজনের গায়ে লাগতে পারে। গৃহকর্ত্রী বলেন, পাশের পাকা বাড়ীতে চাকর ছাড়া অন্য কোন লোকজন নেই। আমরা ইচ্ছা করলে দেয়াল টপকে সেখানে যেতে পারি। তার কথায় আমি পাশের পাকা বাড়ীতে যাই। তাজউদ্দিন ভাই ঐ বাড়ীতে গেলেন না।

 এলোপাতাড়ি গুলি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলে। পরে শুনেছি, এটা ছিল প্রথম পর্যায়ের অপারেশন। পাক বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশকে আতংকিত করে ঢাকাবাসীকে গ্রামের দিকে ঠেলে দেয়া। বস্তি এলাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নীড়হারা বস্তির হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। আতাউল হকের নির্মাণাধীন বাড়ীর ভেতরে খোলা আকাশের নীচে বস্তির বহু লোক আশ্রয় নিয়েছে। ছিন্নমূল মানুষগুলো সামান্য আসবাবপত্র