পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৭

 চুয়াডাঙ্গায় তৌফিক, মাহবুব ও মেজর ওসমানের সাথে আবার বৈঠক করি। ডাঃ আসহাবুল হক আমাদের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করছেন। অস্ত্রের জন্য ভারতে যে আমাদের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।

 বেলা ৩টার দিকে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই সীমান্তের পথে রওয়ানা হই। তওফিক ও মাহবুব আমাদের সাথে ছিল। পলায়নী মনোবৃত্তি নিয়ে সীমান্ত পার হবো না বলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। স্বাধীন সরাকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ্য মর্যাদা নিয়েই আমরা ভারতে যাব। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের গ্রহণ করলেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে আমাদের আলোচনা সম্ভব।

 সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট খালের ওপর একটি বৃটিশ যুগের তৈরী কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দিন ভাই ও আমি বসে আছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে তওফিক ও মাহবুবকে ওপারে পাঠাই।

 তাজউদ্দিন ভাইকে বিষণ্ণ মনে হলো। তার বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, ছোটবেলার একটা কথা তার মনে পড়ছে। তিনি বলতে থাকেন ছোটবেলা হিন্দু সহপাঠীরা বলতেন, তোদের পাকিস্তান টিকবে না। আমি পাল্টা জোর দিয়ে বলতাম অবশ্যই টিকবে। ছোটবেলার সহপাঠীদের কথা তার মনে পড়ছে। সূর্য ডুবু ডুবু করছে বাংলাদেশের আকাশে আবার কখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, তা ভাবতে আমরা দু’জনেই কালভার্টের ওপর শরীর এলিয়ে দেই।

 তওফিক এলাহী ও মাহবুব চলে যাওয়ার পর অনেক্ষণ কেটে গেল। ওরা ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে গেছে। জঙ্গলের ভেতর বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। জনবসতি নেই বললেই চলে।

 চারদিকে আগাছায় ভরে গেছে। আরো কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দিন ভাইকে ডেকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াই। শব্দ ক্রমশঃ আমাদের দিকেই আসছে। আগন্তুকরা কছে এসেই হাতের অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় আমাদের অভিবাদন জানান। অফিসারটি জানান, আমাদেরকে তিনি যথোপযুক্ত সম্মান দিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যেতে এসেছেন।

 আগন্তুক অফিসারের সাথে আমরা ছাউনিতে চলে যাই। ছাউনিতে গিয়ে জানতে পারি আমাদের আগমনের খবর ইতিমধ্যে কোলকাতায় পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনীতে এসে পৌঁছলেন। আমরা আমাদের সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সাহয্যের আবেদন জানাই।

 মজুমদার বলেন, আপনাদের আবেদনের জবাব শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই বলতে পারেন। তিনি জানান, আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। তার সাথে কোলকাতা যাওয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে, তার পক্ষে ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র দেয়া সম্ভব। তবে দিল্লীর সাথে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়। তওফিক এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় দিয়ে মজুমদারের জীপে করে আমি ও তাজউদ্দিন ভাই কোলকাতা যাত্রা করি।

 মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, আমাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লী থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। তার এ কথা শুনে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হই। রাতেই তার সাথে যোগাযোগ করেন। জীপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রংএর একটি গাড়ীতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছ“ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়ীতে উঠলেন। মজুমদার তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএস এফ-এর প্রধান রুস্তমজী।