পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৯

 আমাদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো। যেসব স্থানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধের প্রধান কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুক্ষণ পর চুয়াডাঙ্গার সাথে যোগাযোগ হলো। চুয়াডাঙ্গাকে আমরা বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা মনে মনে ঠিক করেছি। পরদিন দেখি, সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই খবর ফাঁস না করার জন্য ডাঃ আসহাবুল হককে আমি অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, আনন্দের অতিশয্যে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে তিনি তা বলে দিয়েছেন। ডাঃ আসহাবুল হক, মেজর ওসমান ও তওফিক ইলাহীর সাথে আমাদের ফোনে যোগাযোগ হলো। মেজর ওসমানকে বললাম তার সাথে সহসাই আমাদের দেখা হবে। তিনি বেশ প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি তালিকা তৈরী করে রাখেন।

 সেদিন ছিল কোলকাতায় ‘বন্ধ’। বাংলাদেশের আন্দোলনের সমর্থনে এই বন্ধ ডাকা হয়। কোলকাতার জনজীবনে একেবারে স্তব্ধ। গাড়ী ঘোড়া সবকিছূ বন্ধ। কোলকাতার ভাইরা সেদিন আমাদের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। কোলকাতস্থ পাক সরাকারের কার্যালয়ের চারিদিকে হাজার হাজার জনতা বিক্ষোভ প্রকাশ করেন।

 আমাদের জন্য একটা বাড়ী দরকার। রুস্তমজী বাড়ির সন্ধানে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাকিস্তান কনস্যুলেট-এর কাছে আমাদের জন্য একটি বাড়ি নির্বাচিত করা হলো।

 ঘরে ফিরেই তাজউদ্দিন ভাই ও আমি তিনটি খসড়া পরিকল্পনায় হাত দেই। এগুলো হলো দলের সাংগঠনিক, সরকার গঠন ও সামরিক পরিকল্পনার কাজ। যা মাথায় এসেছে, তাই লিখেছি। সাথে সাথে ছক কেটে তীর চিহ্ন দিয়ে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করেছি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের জন্য সারাদেশকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়।

 পরদিন আমাদের দিল্লী যাওয়ার কথা। বিএসএফ ও অন্যরা খুবই সবধানতা অবলম্বন করছে আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য। পরদিন সকালে সীমান্তের দিকে যাই। খবর অনুযায়ী মেজর ওসমান অস্ত্রশস্ত্রের একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে আসেন। মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্র দেয়া হলো। এর মধ্যে এলএমজিও ছিল। ইতিমধ্যে খবর এলো পাক সৈন্যরা যশোর সেনানিবাস থেকে বের হবার চেষ্টা করছে। তাকে এক্ষুণিই যেতে হবে। মেজর ওসমান সদ্য পাওয়া এলএমজি কাঁধে নিয়ে দ্রুত রওয়ানা হলেন।

 চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর ওসমানের সাথে তার স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই তেজস্বী মহিলা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাহসী এই বীরের স্ত্রী বেগম ওসমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরনার উৎস হয়ে ওঠেন। একদিকে তিনি স্বামীকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতেন, অপর দিকে বিডিয়ার জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অনুপ্রাণিত করতেন। নিজের হাতে রান্না করে তিনি যুদ্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দিতেন।

 ১৯৭১সালের ৬ই নভেম্বর রাতে সেনা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ওসমান নিহত হন।

 ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল। আজ আমরা দিল্লী যাচ্ছি। গোলক মজুমদার আমাদের সাথে আছেন। সরজিৎ চট্টপাধ্যায়ের বিমানবন্দরে আমাদের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট কক্ষে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। সাংবাদিক ও অন্যান্য যাত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে আমাদের যেতে হবে। ইতিমধ্যে চট্টপাধ্যায় আমাদের দুজনের জন্য একটি স্যুটকেস ও একটি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। হাত ব্যাগে কাগজপত্র, কলম, পেন্সিল ইত্যাদি রয়েছে। স্যুটকেসে আমাদের পরিধেয় কাপড়, তোয়ালে ও সাবান। রাত ১০টার দিকে জীপে করে একটি মিলিটারী বালবাহী বিমানের কাছে আমাদের নিয়ে আসা হল। মই দিয়ে আমরা বিমানের ককপিটে উঠি। পাইলট ও তার সহকারীদের ছাড়া বিমানে বসার জন্য কোন আসন নেই। শুধুমাত্র কেনভাসের বেল্ট দিয়ে আমাদের চারজনের বসার একটি ব্যবস্থা করা হল। বিমানের পিছন দিক উন্মুক্ত। এদিয়ে অনায়াসে মাল উঠা- নামা করা যায়। তখনও এতে মাল ভর্তি ছিল। এই মালবাহী সামরিক বিমানে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সকল এজেন্সী থেকে আমাদের যাত্রা গোপন রাখা।