পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭১

জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় সত্তা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা আমাদের ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূ-খণ্ডের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি।

 ৪ঠা এপ্রিল তাজউদ্দিন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাদের কোন সহযোগী ছিল না। বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও পূর্বাপর আলোচনার বিষয় আমার জানা ছিল। সাক্ষাতে যাওয়ার পূর্বে তাজউদ্দিন ভাই আমার সাথে কয়েক ঘণ্টা ধরে সম্ভাব্য আলোচনা সূচী নিয়ে আলোচনা করে যান।

 মিসেস গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর তাজউদ্দিন ভাই আমাকে সব কিছু জানান। মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। তাজউদ্দিন ভাই-এর গাড়ী পৌঁছে যাওয়ার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্টাডী রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন। ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?’ এই প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কেননা এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদেরকে আরো অনেকবার হতে হয়েছে। মিসেস গান্ধীর পশ্নের জবাবে তাজউদ্দিন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫শে মার্চের পর তাঁর সাথে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি। সাক্ষাতে তাজউদ্দিন ভাই আরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য। মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে তাজউদ্দিন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশের নেতা জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।

 আমরা একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করি। কেননা ভারত সরকারের সাথে একটি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কথা বলা উচিৎ। এদিকে সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন ফ্রণ্ট থেকে চাপ আসা অব্যাহত রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাইকে খুবই চিন্তিত মনে হয়। অস্ফুটস্বরে তিনি বলে ফেলেন বঙ্গবন্ধু আমাকে কি বিপদে ফেলে গেলেন। আমি বিরক্তির সাথে জানতে চাইলাম সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাই দ্বিধাগ্রস্ত কেন? জবাবে তাজউদ্দিন ভাই বলেন, আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জানেন না। সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝি। জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই তা প্রয়োজন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

 আমার সরল মনের কাছে দেশের এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক চেতনার দিক দিয়ে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলে মনে হয়।

 তাজউদ্দিন ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে? আমি স্বাভাবিক উত্তর দিলাম। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে রেখে গেছেন। আমি বললাম, যে ৫ জন নিয়ে বঙ্গবন্ধু হাই কম্যাণ্ড গঠন করেছিলেন, এই ৫ জনকে নিয়েই সরকার গঠন করা হবে। দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু, সাধারণ সম্পাদক ও তিনজন সহ-সভাপতি নিয়ে এই হাই কম্যাণ্ড পূর্বেই গঠিত হয়েছিল। তাজউদ্দিন ভাই পুনরায় প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? দ্বিধা না করে এবারও জবাব দিলাম, ২৫শে মার্চের পর থেকে আজ পর্যন্ত যিনি প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনিই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের দায়িত্ব পালন করবেন।

 তাজউদ্দিন ভাই অনেক্ষণ ভাবলেন। আমার প্রস্তাবের যৌতিকতা কোনভাবেই তিনি নাকচ করতে পারলেন না। তিনি এত বেশি কেন ভাবছিলেন তার উত্তর জানতে আমার অনেক সময় লেগেছিল।