বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
93

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খণ্ড

১০ জুলাই, ১৯৭১

  রাওয়ালপিণ্ডি থেকে দুটো পত্র পৌঁছেছে লণ্ডনে। সরকারীভাবে সরকারী চিঠি। এগুলো নাকি প্রতিবাদলিপি। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ? দুনিয়া তাজব হয়ে গিয়েছে খবরটা শুনে। পাকিস্তানী জল্লাদ সরকার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে বৃটেনের সংবাদপত্রে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চলছে- এ প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা হোক।

  বিশ্ববাসীর মনে স্বভাবতই দুটো প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার পরেও যে পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকচক্র অতীতের রেশ ধরে বাংলাদেশের ঘটনাকে এখনও আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। আর শুধুমাত্র অস্ত্রপাতির জোরে বলে বেড়াচ্ছে যে বাংলাদেশ তাদের দখলে রয়েছে- তারা বৃটেনের খবরের কাগজগুলি কি লিখছে না লিখছে তার ওপর খবরদারি করতে চাইছে কোন লজ্জায়? এটা হতে পারে প্রথম প্রশ্ন।

  দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভিন্ন ব্যাপার থেকে এসেছে। পাকিস্তানী জল্লাদেরা নিজেদের হাতে জুলিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম নগরীতে রাজমিস্ত্রী দিয়ে দুটো-চারটে দালানকোঠা মেরামত করিয়ে আর রং ফিরিয়ে, নিজেদের হাতে খুন করা হাজার হাজার নরনারী-শিশুর গলিত লাশ গুম করে সাফাই-সাক্ষীর মারফত প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে, পাকিস্তানী ফৌজের লোকেরা বেকসুর, মাসুম; তারা দুষ্টের দমন আর ক্যাণ্টনমেণ্টে বসে আছে জনসংযোগ দফতর হাট করে খুলে। ফল এতে উল্টোই হয়েছে। সাংবাদিকরা অবরুদ্ধ নগরীগুলিতে ঢুকবার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এবং ফাঁস করে দিয়েছেন পাকিস্তানী জল্লাদদের সমস্ত গোমর। শেষ রক্ষা করার জন্যে, সত্যের বিশ্বপরিব্যাপ্ত অগ্নিশিখাগুলিকে ঢাকা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা এখন চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দিয়ে কিছু একটা করাতে। কিন্তু এদের মাথায় কি এ কথাটা ঢুকছে না যে, যে হাত দিয়ে এরা সত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র লিখছে, তা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ নরনারী-শিশুর রক্তে রঞ্জিত সে রক্তের দাগ লেগে যাচ্ছে এদের চিঠিপত্রেও? তবে দুনিয়ার সামনে উপরোক্ত দুটো প্রশ্নের একটাই জবাব রয়েছে। দু’কান কাটা রাস্তার মাঝ দিয়েই চলে। আসামীর কাঠগড়ায় উঠে আবোল-তাবোল বকে পাগলের ভান করে। সত্যকে চাপা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কম চেষ্টা করেনি এরা ২৫শে মার্চে নৈশ হামলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীতে সমাগত সমস্ত বিদিশী সাংবাদিকদের হোটেলের কামরায় আটকে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও সেই অবরোধ ভেদ করে সাংবাদিকরা পাকিস্তানী জল্লাদদের নারকীয় কাণ্ডের যে তথ্য আর ছবি নিয়েছিল, সেই সব তথ্য আর ছবি কেড়ে নেয়া হয়েছিল করাচী বিমানবন্দরে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে এরা ঢুকতে দেয়নি, পাছে পাপ প্রকাশ পেয়ে যায় এই চিন্তায়। এরা বাংলাদেশের যেসব খবরের কাগজের অফিসকে দালান সমেত পুড়িয়ে ছাই করেনি, তাদের ওপর জঙ্গী আইনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কোন ফাঁকে যাতে বাংলাদেশ থেকে খবর বাইরে না যেতে পারে সে জন্যে এরা বিদেশীদের জন্যে নির্ধারিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে বুটের তলায় মাড়াতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায়নি। পাকিস্তানী জল্লাদেরা ভেবেছিল, দিন চলে যাবে একরকম করে এবং দুনিয়ার মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে।

("জামিল শারাফী’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

১৬ জুলাই, ১৯৭১

  বাংলাদেশের মত এমন শান্তির দেশ, এমন সুখের দেশ আর কোথায় আছে। এমন জন্মভূমি ক’জনে ভাগ্যে পায়। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গজননী। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা চিরকাল ঘরকুনো। বুঝিবা একটু আডডাবাজ। কিন্তু বাংলার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন গোলমালে নিজেদেরকে জড়াতে চায়নি। মায়ের স্নেহ, দাদা