পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

|18 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বিভিন্ন নিরপেক্ষ বিদেশী সংবাদপত্রের রিপোর্টে এবং মন্তব্যই বিশ্ববাসীর সামনে তার অসারতাকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। সমগ্র দুনিয়ার দৃষ্টি আজ বাংলাদেশের দিকে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ যাতে ঠিক তথ্য জানতে না পারে জল্লাদ ইয়াহিয়ার প্রচারবিশারদরা সেজন্য চেষ্টার এতটুকু কসুর করেনি। পশ্চিম পাঞ্জাবী শিল্পপতি, কায়েমী স্বার্থবাদী এবং শোষককুল পৃষ্ঠপোষিত উপনিবেশবাদী জঙ্গী শাসককুলের গণবিরোধী শাসন ও শোষণের চাকা বন্ধ হয়ে যাবার আশংকায় তাদেরই ভাড়াটিয়া গোলাম জল্লাদ ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ইতিহাসে নজিরবিহীন গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, হিংস্র বর্বরতার সঙ্গে নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের আশ্রয় নিয়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহারা দেশান্তরী করে ইয়াহিয়া খান চেয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তাদের স্বাধীনতার দাবীকে নির্মুল করে দিতে। আর এ বর্বরতার লোমহর্ষক কাহিনী চাপা দিয়ে রাখবার জন্য কুচক্ৰী ইয়াহিয়া বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছিল বর্বর গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর প্রথম মুহুর্তেই। কিন্তু তার অসদুদ্দেশ্য সফল হয়নি। ইয়াহিয়া একদিকে যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পারেনি, তেমনি পারেনি বাংলাদেশে তার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রাখতে। বহুদিন কড়া সেন্সরশীপ আরোপ রেখে, কিছু অসৎ সাংবাদিক ভাড়া করে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে জল্লাদশাহী নিজেদের পাপকীর্তি চাপা রাখার, বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমগ্র দুনিয়াব্যাপী সংবাদপত্র জগৎ এর জনমতের প্রচণ্ড চপে বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান বিদেশী সাংবাদিকদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়েছে। প্রথম সুযোগেই দুনিয়ার দশদিগন্ত থেকে খ্যাতনামা পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা ছুটে এসেছেন যুদ্ধবিক্ষত বাংলাদেশে। তারা দেখেশুনে বিস্মিত হতবাক হয়ে গেছেন। ভিয়েৎনাম, আলজেরিয়া, কিউবার বিপ্লব আর জনযুদ্ধসারা পৃথিবীর মানুষের সপ্রশংসা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আট মাস সময়ও অতিক্রান্ত হয়নি কিন্তু এরি মধ্যে বীর প্রসবিনী বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা যে অভূতপূর্ব বীরত্ব সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসে তার আর কোন নজির নেই। ইয়াহিয়া খান ৭২ ঘণ্টার ‘ক্রাশ বেঙ্গলী পোগ্রামের হিংস্র নখরাঘাতে শুরুতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দাবিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের তীব্রতায় জল্লাদী খোয়াব ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আজ জল্লাদী সাম্রজ্যের মোহই চূড়ান্তভাবে ক্রাশ হবার দ্বারপ্রান্তে। বিদেশী সাংবাদিকরাই নিজের চোখে দেখছেন প্রতিদিন প্রতিটি রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটছে। প্রতিদিন মুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা-নতুন নতুন অঞ্চলে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। আর তাই হানাদার জঙ্গীবাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়ে বিদেশী সাংবাদিকেরা সত্যভাষণের স্বার্থেই বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীন হবেই-কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ২৬শে নভেম্বর, ১৯৭১ জল্লাদ ইয়াহিয়া খান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছে যে, বর্তমান পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তানের সম্পদ এমন একটি এক জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে যেখান থেকে আর ফিরবার উপায় নেই। রেডিও পাকিস্তানের কাজ অনুসারে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছে, পাকিস্তানের সম্মান ও অখণ্ডতাকে সে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। ইয়াহিয়া খান আবার অভিযোগ করেছে যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ পরিচালনার ফলেই উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।