পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড কিন্তু এই নিষ্ঠুর বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে কষ্ট হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের। তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছে শেষরক্ষার জন্য -ধর্না দিয়েছে আমেরিকার দুয়ারে। আমেরিকা এগিয়ে এসেছে খুনী নিক্সনের দোসর জল্লাদ চিতাগ্নি থেকে রক্ষা করতে। ইয়াহিয়ার সরকার মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম নরমেধযজ্ঞের নায়ক-এক কলঙ্কিত সরকার। এই সরকারের চেহারাটা বিশ্ববাসীর কাছে এত বেশী ঘৃণাদায়ক যে খোলস বদল ছাড়া ওকালতির ও সাহস পাচ্ছে না নিক্সন। সম্ভবত সে কারণে -ওয়াশিংটনের অদৃশ্য সুতার টানে ইয়াহিয়া নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী আর ভূট্টোকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। উদ্দেশ্য : বাঙালী নুরুল আমিন আর সিন্ধী ভূট্টোকে মঞ্চে খাড়া করে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়া যে, পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। জনগণ পাকিস্তানই চায়-ভারতই পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার জন্য পূর্ব বাংলা দখল করার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগে ভূট্টোকে অন্ত্র ভিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল চীনে। এবার তাকেই মৃত পাকিস্তানের সঞ্জীবনী সঙ্গীত গাইবার জন্য পাঠানো হয়েছে জাতিসংঘে। ইয়াহিয়ার বড় আশা, ভূট্টো ব্যারিস্টার, তুখোড় বক্তা-নিশ্চয় সে সবকিছু গুছিয়ে বলে সারা দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবে। হায়রে দুরাশা! ইয়াহিয়া হয়তো জানেই না যে, কথার মারপ্যাচে ধোঁকাবাজির দিন বাসি হয়ে গেছে। আসল সত্য, উপমহাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। তার প্রমাণ বিদেশী পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে ও নিবন্ধ। লণ্ডনের গার্ডিয়ান’ পত্রিকা লিখেছে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রেত হোক আর না হোক, ধ্বংস আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যদি এরপর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অতি নাটকীয় কিছু ঘটে তবু বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কোনমতেই সম্ভব হবে না। গার্ডিয়ান আরও বলেছে, ইয়াহিয়া যদি এখন আলোচনায় বসতে চায়, সে আলোচনার মূল বিষয় হবে কি উপায়ে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ফিরিয়ে নেয়া যায়। আমেরিকার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব অনেক দেরীতে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিরোধের সময় পার হয়ে গেছে। নিউজউইক’ লিখেছে, পাকিস্তানের মৃত্যুচিৎকারের মধ্যেই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে নবজাত বাংলাদেশের প্রথম জন্মধ্বনি। আমাদের আর কিছু বলবার দরকার আছে কি? ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অনিবার্য পতনের মুখে জঙ্গীশাহীর সাম্রাজ্য। বডেডা প্ৰাণ লাগছে, সাধের উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে গালে চড় খেয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখছে। বীরবর জওয়ানরা লড়াই করা তো দূরের কথা, প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পণ করছে মিত্রবাহিনীর কাছে। তবু অবশ্য আশানুরূপ সাড়া এখনো মেলেনি। আজ পর্যন্ত অফিসার এবং জওয়ান মিলিয়ে ৮ হাজার অস্ত্র ফেলে আশ্রয় ভিক্ষা করেছে। বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করার স্বপ্ন যারা দেখেছিল, বাংলাদেশে জুলুমের এবং ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যারা বাংলাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, তারা প্রত্যক্ষভাবে কেউই বাংলার অকুতোভয় মুক্তিবাহিনীর ধামচাপা দিতে চাইছিল। পিণ্ডির সদর দফতরে যুদ্ধের ঢেউয়ের আঘাত লেগেছে কিন্তু বাংলার মাটিতে মৃত্যভয়ে ভীতি খানসেনাদের আর্তহাহাকারের কোন শব্দ হয়তো পৌছায়নি। কিন্তু সত্যকে গোপন করে বাস্তবকে অস্বীকার করা যায় না। সেটা বোধগম্য হয়েছে জল্লাদশাহীর অনেক দেরীতে। যুদ্ধরত সৈনিকের আকুল আবেদন পৌছেছে রাষ্ট্রসংঘের দরবারে, কিন্তু সে আবেদনের সাড়া দেবার এখতিয়ার নেই রাষ্ট্রসংঘের। বাংলাদেশে জল্লাদবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ নিয়াজী সমস্ত অনুরোধ-উপরোধ নাকচ

  • সংবাদ পর্যালোচনা’র এই কথিকাটি মুস্তাফিজুর রহমান রচিত।