পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

140 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড এ ধ্বনি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে আঘাত করলো বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর সে ঢেউ এসে সাড়া জাগালো হজরত শাহ মখদুম শাহদ্দৌলার পদস্পর্শে পবিত্র শাহজাদপুরসহ পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, উল্লাপাড়া, ফরিদপুরসহ আরও অসংখ্য গ্রামে। প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলো সবাই। মুক্তিবাহিনী গঠিত হল মহল্লায় মহল্লায়। মা-বোনেরা এবং অশীতিপর বৃদ্ধও এসে দাঁড়ালো মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সবার মুখেই একই মন্ত্র “জয় স্বাধীন বাংলা”। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলে শত্রু বাহিনীর আগমনের- মোকাবেলা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে। কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে দা এবং কারও হাতে মজবুত লাঠি। বাইরে থেকেও মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা এলো। বিভিন্ন জায়াগয় ছাউনি ফেলা হল। শেরপুর থেকে নগরবাড়িঘাট পর্যন্ত ঐ রকম ছাউনি পড়লো পাঁচ-ছয়টা। এ পর্যন্ত ছাউনিতে বাংলার মুক্তিসেনাদের হাতে সাধারণত বন্দুক, রাইফেল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে নেওয়া কিছু উন্নত ধরনের অস্ত্র থাকতো। সোনার বাংলার সোনা মুক্তিযোদ্ধাদের জনতা আপন করে নিল। নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখতে পেল স্বাধীন বাংলার প্রতিচ্ছবি। একটি ঘটনা বলি। একদিন দুপুরের দিকে খেয়া নৌকায় পার হচ্ছি। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন যুবক। নৌকারোহীরা মুক্তিসংগ্রামে মোমেনের ত্যাগের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছে। একজন অশীতিপর বৃদ্ধ উঠে এলেন আমাদের কাছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমরাই তো বাবা অবহেলিত, লাঞ্ছিত বাংলার চোখের মণি। তোমাদের রক্তের বিনিময়ে আমার মাতৃভূমি শত্রমুক্ত হবে। আমি মুক্ত বাংলায় মরতে পারবো। আমাদের পরবর্তী পুরুষকে আর পরাধীনতার গ্রানি সহ্য করতে হবে না। কি গৌরব এ ত্যাগের! জয় তোমদের হবেই বাবা, ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হবেই। এ যুদ্ধ তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। দুর্ভাগ্য, অনেক বয়েস হয়েছে আমার অস্ত্র ধরবার ক্ষমতা এখন আর নেই। কিন্তু তবুও যদি আমাদের মত নিরস্ত্র হয়ে সামনে আসতো শত্র তবে এ বয়সেও একবার দেখিয়ে দিতাম বিশ্বাসঘাতকের কি শাস্তি।” ভাবছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এই আশীবাদের উপর শ্রদ্ধা রেখে, মাতৃভূমিকে মুক্ত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো অসংখ্য রণাঙ্গনে বাংলার রতুরা সদাসচেতন প্রহরী হয়ে রয়েছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য। চিন্তা করার আর সময় হয়নি। বৃদ্ধকে মৌখিক শ্রদ্ধা নিবেদনও করা হয়নি। হঠাৎ শুনতে পেয়েছিলাম মারণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ। খুব কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পরে খেয়াল হল অদূরে পাইকারহাটির ডাববাগানে মুক্তিবাহিনীর ছাউনির কথা-আমাদের বাহিনীর ৬০ জন মুক্তিসেনার কথা। তখন বেলা প্রায় দুটো। পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যরা ১৪ খানা ট্রাকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে কাশিনাথপুর থেকে আসছিল বাঘাবাড়িঘাট অভিমুখে। মাঝপথে ডাববাগানে। ট্রাগারে হাত রেখে মুক্তি বাহিনীর জোয়নরা প্রস্তুত। শত্রসেনাদের ট্রাকগুলো ওদের আওতায় এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো মুক্তিসেনাদের রাইফেল আর ব্রেনগানগুলি। শত্রবাহিনীর পাঁচখানা সৈন্যবাহী ট্রাক অকেজো হয়ে গেল গুলির আঘাতে। প্রাণ দিল ৫০/৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য। এ যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর একজন গুরুতররূপে আহত হয়েছিল- EPR- এর লোক। অদ্ভূত শরীর। তার গায়ে বিদ্ধ হয়েছিল ৫/৬টা বুলেট অচেতন অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হল ফ্রন্ট থেকে। ডাক্তারগণ তাকে ঔষধ দিচ্ছেনঅপারেশন করে তার শরীর থেকে শত্রবাহিনীর বুলেট বের করছেনর। বাঁচার আশা খুবই কম। আমরা সেবা করছি কায়মনোবাক্যে ও চোখ মেলে চাইলো। জিজ্ঞেস করলেও মুক্তিসেনাদের কুশল, অগ্রগামী অবস্থানের পরিস্থিতি। মুমূর্ষ অবস্থায়ও ওর চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল মাতৃভূমিকে শত্রমুক্ত করার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা। করুণাময় আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপায় ও বেঁচে আছে। মনে হয় বাংলার কোন প্রান্তে আবার সে অস্ত্র তুলে নিয়েছে শত্রসেনাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। খোদার অসীম রহমত আছে ওর উপর, কারণ ও তো সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। পরে পাকিস্তানী বাহিনীর কামান আর মটারের আঘাতে ডাববাগান নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল পাশ্ববর্তী গ্রামগুলো। মুক্তিযোদ্ধারা তবুও নির্ভয়। তারা আবার ঘাঁটি গড়ালো ঘ্যাটনা ব্রীজের তলায়। পণ করলো, পাকস্তানী বাহিনীকে কিছুতেই সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না কয়েকদিন পর শত্রসেনারা ট্রেনে সৈন্য বোঝাই করে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে সিরাজগঞ্জের দিকে। কিন্তু মুক্তিসেনারা ঘ্যাটনা ব্রীজের কাছে রেলের ফিস-প্লেট তুলে রেখেছে। ট্রেন থেমে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রেন