পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

144 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড জেলে আটকে রাখা হয়েছে। জেলেই তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। মুক্তিলাভের পর দেশের বাইরে সুদূর বৈরুতে প্রিয় পরিজনের সান্নিধ্য থেকে বহুদূরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের আরেক জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি এখনো আমাদের মধ্যে আছেন। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের পর গিয়েছিলেন লণ্ডনে। তিনি দেশে ফেরার আগেই হয়ে গেল সব ওলটপালট। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে কলমের এক খোঁচায় বরখাস্ত করে দিলেন বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ। ফজলুল হক হলেন নজরবন্দি। গোলাম মোহাম্মদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসকান্দার মীর্জা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, মওলানা ভাসানী যদি দেশে ফেরেন, তাকে আমি গুলি করার নির্দেশ দেব।’ বিবরণ দিতে গেলে এক মস্তবড় পুথি তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের এমন একজন নেতা, এমন একজন অমর্যাদা করেনি। তাই এবারেও বৃটিশ পার্লামেন্টার প্রতিনিধিদলের কাছে পাকিস্তানের বর্তমান ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীচক্রের নাক ইয়হিয়া খাঁ যখন বলেন শেখ মুজিব একজন ক্রিমিনাল, তখন আমরা বিস্মিত হই না। ইয়াহিয়ার মত একজন অর্ধশিক্ষিত বর্বরের কাছ থেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা সম্পর্কে এর চাইতে শোভন ও ভদ্র ভাষা আমরা আশা করি না। যে ব্যক্তি নিজে ক্রিমিনাল,যার হাতে এখনো নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালীর বুকের তাজা রক্ত লেগে রয়েছে, ইতিহাসের সেই জঘন্যতম খুনী দস্য বাংলার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক মহান জননায়ক সম্পর্কে শ্রদ্ধাভরে কথা বলবেন, এটা কেমন করে সম্ভব হয়? আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে অনেক মহান নেতা জন্মেছেন। দেশের জন্য তারা যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তারা সকলেই আমাদের শ্রদ্ধেয়। তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, নির্যাতন বরণ ও নেতৃত্বাদানের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুগ সৃষ্টিকারী নেতা। তার ত্যাগ, সাহস ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়। তিনি এখন শুধু বাঙালীর নয়নমণি নন, কিংবদন্তীর রাজা। জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রায় বারটি বছর তিনি কাটিয়েছেন জেলে। ইয়াহিয়ার আগে আইয়ুব একবার তার গলায় ফাসির রজ্জ্ব পরাতে চেয়েছিলো। পারেনি। এখন আবার সেই ফাঁসির রজ্জ্ব হাতে নিয়ে খুনী ইয়াহিয়া নতুন খুনের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবের অপরাধ তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের মানুষ তাকে ভালোবাসে। শেখ মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে যে অধ্যায় যোজনা করেছেন, তার কোন দ্বিতীয় নজির নেই। একটি নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনকে রজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের প্রভাবে তিনি রূপান্তরিত করেছেন বিপ্লবে। বিপ্লবকে রূপান্তরিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ ইতিহাসের সবচাইতে জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ড রুখে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি সুদক্ষ ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে বলতে গিয়ে প্রায় খালি হাতে লড়ছে। এ কি ইতিহাসের কম বড় বিস্ময়? এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে একটিমাত্র মানুষের সবল ও প্রেরণাদানকারী নেতৃত্বের জন্য। একটি নামই আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেছে। আর বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের নতুন সংগ্রামী ইতহাস। তাই বাংলাদেশের ঘৃণ্য শত্রু ইয়াহিয়া, হামিদ ও টিক্কা খাঁর দল এই ইতিহাস এবং এই ইতিহাসের নায়ক শেখ মুজিবকে ধ্বংস করার জন্য পাগলা কুকুরের মত হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবকে জেলে বন্দী রেখে কাপুরুষ ইয়াহিয়া সাহস ও স্বস্তি পাচ্ছে না। সুতরাং বিচারের নামে তাকে হত্যা করার এই শয়তানি চক্রান্ত।... (আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত) ২০শে আগষ্ট, ১৯৭১ (এই পর্যায়ের শেষ আলোচনা) সত্তরের নির্বাজচনবিজয়ী বাংলাদেশের একচ্ছত্র জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার গোপন চক্রান্ত চলছে পকিস্তানী নাৎসীদের জেলে। এটা যেবিচার নয়, বিচার প্রহসন এবং হত্যা করার নারকীয় চক্রান্ত,