বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
152
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খণ্ড

থাকা যায়? চোখের সামনে মা, বোন, ভাই, বাপ, বন্ধুবান্ধব সকলকে ঘাতকেরা হত্যা করছে। এই জল্লাদদের অকথ্য অত্যাচারে সোনার বাংলা আজ শ্মশান।

 বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্ধন হচ্ছে ভাষার বন্ধন। বাংলা-বাংলা ভাষাভাষীর দেশ। কি করে সহ্য করা যায় বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে হানাদারদের আনাগোনা? তবু সহ্য করতে হয়। সারাদিন রাত–কাটে এক ত্রাসের মধ্যে, এক দুঃস্বপ্নের জগতে। বেয়নেটের মুখে বিপন্ন অস্তিত্ব!

 শামসুর রাহমান এখন পত্রিকা অফিসের তেতলায় বসে কবিতা লিখছেন কি? তাঁর বিষণ্ণ চোখ দুটোতে নিশ্চয় দশ লাখ মৃত মানুষের পুঞ্জীভূত নিষ্পলক দৃষ্টি লেগে রয়েছে। দুঃখ, মহা দুঃখ! আর এই দুঃখ অহরহই নাম লিখেছে- বাংলার প্রতিটি পর্ণ কুটিরে-ভাবনার আদিগন্ত জুড়ে।...

 শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন নিশ্চয় বেয়নেটের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সৃষ্টির উন্মাদনায় একর পর এক এঁকে চলেছেন ধর্ষিতা বাংলার ছবি। আরব গেরিলা শিবিরে থাকাকালে তার তুলিতে জ্বলে উঠেছিল আগুন- আর সেই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা পেয়েছিল আরব মুক্তিযোদ্ধারা। আমরাও সে্ মন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছি।

 জিন্না এভেন্যুর রেস্তেরাঁতে নববিবাহিত শহীদ কাদরী কি এখনও সন্ধ্যা কাটান? রক্ত, রক্ত চায়ের কাপে, ফ্রিজের জলে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে বৃষ্টির শব্দকেও কি তার দশ লাখ মানুষের আত্মার হাহাকার মনে হয়?...

 আবুল হাসান কি এখনও হাসপাতালে পড়ে আছে? অসুখে নয়, জল্লাদের গুলীতে আহত হয়ে। নাকি সে পড়ে পড়ে ধুঁকছে কোন মেসের আলোহীন কক্ষে– আলোর প্রতীক্ষায়। ... সে কি এক মিলিয়ন শবের দুঃস্বপ্নে ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠে?

 রফিক আজাদের অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস নিশ্চয়ই এখন বারুদের আগুন হয়ে শত্রুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে?

 .... তোমাদের মৃত্যু নেই। তোমাদের স্থান সাড়ে সাত কোটি বাঙারীল মনের মণিকোঠায়।

 বিশ্ববিবেক তোমাদের দিকে। তোমাদের ভয় কি?

 জয় আমাদের হবেই। তোমাদের মসিকে করে তোল জিঘাংসু ধারালো হাতিয়ার। পড়ে পড়ে মার খাবার দিন চলে গেছে। তোমার প্রাণের ভাষা তোমার পবিত্র জন্মভূমি জননী বাংলাকে ওরা ধর্ষণ করছে। তোমরা দেখিয়ে দাও রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।

 আমরা তোমাদের পাশেই রয়েছি। পশ্চিম বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে চাই–

“মরো কিন্তু মেরে মরো এবং উদ্ধার করো ঘর–
নিশ্চিত রয়েছি পাশে আমি তোর জন্ম সহোদর।”...

(রণজিৎ পাল চৌধুরী রচিত)