পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

156 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড কেউ শোনে না। কে শুনবে? যারা নিজেদের চোখে দেখেছে মেঘনা নদীকে কারবালার রক্তরাঙা ফোরাত নদী হয়ে যেতে, যাদের চোখের সামনে হয়েছে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, তারা কি করে বিশ্বাস করবে দখলীকৃত ঢাকা বেতারের নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচার? গল্পের পাগলা মেহের আলীর মতো অবস্থা হয়েছে ঢাকা বেতারের। মেহের আলী থেকে থেকে কেবল বলতো, সব ঝুট হ্যায়- সব বুট। ঢাকা বেতারও সেই মার্চ মাসের সাতাশ তারিখ থেকে কেবল চেচাচ্ছে, সব নর্মাল হায়- সব নর্মাল। এবার রমজান মাসের শুরুতে যশোরের এক মুক্তাঞ্চলে গিয়েছিলাম। দেখি মাগরিবের নামাজ ও ইফতার সেরে গ্রামের মসজিদের এক ইিমাম সাহেব তার ট্রানজিষ্টর রেডিও নিয়ে বসেছেন। নিবিষ্ট মনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান গুনছেন। পরিবেশটি বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ নেই। মিটি মিটি জুলছে তারার প্ৰদীপ। কার্তিকের হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। যে পুকুরের পাড়ে ইমাম সাহেব বসেছেন, তার পানিতে ঝিকিমিকি তারার প্রতিভাস। কদিন আগেই এই গ্রামটিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে- তার চিহ্ন এখন নেই। হানাদারের পালাবার সময় কোন কোন বড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ধানের গোলা পুড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রামের মানুষ আবার নতুন উৎসাহে ঘর বাঁধার কাজে হাত দিয়েছে। তাদের কেউ হারিয়েছে তার প্রিয়তম ভাইকে। কেউ হয়েছে পিতৃহারা। কারো যুবতী বোন লাঞ্ছিত হয়েছে বর্বর হানাদার দসু্যদের হাতে। কিন্তু তাতে কারো চোখে অশ্রুকণা নেই। সব অশ্রুকণা পুড়ে যেন ক্রোধের বারুদ হয়ে গেছে। সকলের মুখে, সকলের বুকে এক প্রতিজ্ঞা- মরতে হয় আরো মরবো, তবু হানাদারদের দেশছাড়া করবো। ইমাম সাহেবের পাশে বসে আমি দেখছিলাম সোনার বাংলার সংগ্রামী রূপ। এই তো কার্তিকের হিমে ভেজা বাংলার সবুজ ঘাস। মাথার উপরে সাদা মেঘের কারুকাজ করা নীল আকাশ। ইমাম সাহেব নিবিষ্ট মনে শুনছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম। এই গ্রামে আপনি কি একাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনেন, না সবাই শোনেন? ইমাম সাহেব হেসে বললেন, কি যে বলেন, সবাই শোনে। এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য আমরা সারাদিন পাগল হয়ে থাকি। প্রশ্ন করলাম, এই অনুষ্ঠান শুনে কি লাভ হয় আপনাদের? ইমাম সাহেব বললেন, আমাদের আশা বাড়ে, সাহস বাড়ে, বুকের হিম্মত বাড়ে। এরপরই আমার কাছে সরে এসে বললেন, একটা সত্য ঘটনা বলি শুনুন। তখনো আমাদের এই গ্রাম মুক্ত এলাকা হয়নি। পাকিস্তানী সৈন্যরা চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে, দিনে-দুপুরে লুটপাট চালাচ্ছে, ঘরের মেয়েকে আর ভাবি, মুক্তিবাহিনীর নওজোয়ানেরা কবে আমাদের গ্রামে আসবে? আমার ছোট নাতিটির বয়স বছর দশ। সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। আমি তাকে একদিন সাবধান করে দিলাম, বললাম- নানু, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনিস না। মিলিটারিরা জানতে পারলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। নাতি বলল, কতজনকে মারবে! এই গ্রামের সকলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। কেউ ঢাকা বেতারে হুক্কামে মারশাল ল’-র অনুষ্ঠান শোনে না। এর পরই নাতি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো- আচ্ছা নানা, হুক্কামে মারশাল ল’র অর্থ কি? নাতির প্রশ্ন শুনে এই বুড়ো বয়সেও ঠাট্টার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, নানু, হুক্কামে মারশাল ল’-র অর্থ- মার শালাদের। এই শালা কারা জানো? ওই বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা। বৃদ্ধ ইমাম আর নাতির গল্প শেষ করে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। আমি তাকে বললাম, আপনার নাতির কথা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আপনি এবং আপনার এই মসজিদের অন্যান্য মুসল্লিরাও কি ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শোনেন না?