রাত্রির তপস্যা সেকি আনিবে না দিন
নিদারুণ দুঃখ রাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চূর্নিল যাবে নিজ মর্ত্যসীমা
তখনও দেবে না দেখা
দেবতার অমর মহিমা?
৩০ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন চরম বিজয়ের লক্ষ্যপথে অগ্রসর হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, অমিতবিক্রম মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমশই তারা সংগঠিত হচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছেন, দুর্বার দুর্জয় হচ্ছেন। আর অন্যদিকে সেই সঙ্গে যতই দিন যাচ্ছে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ততই দুর্বল হচ্ছে, মনোবল ও নৈতিক সাহস হারাচ্ছে। এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তারুণ্য ও নৈতিক মনোবল হানাদার দস্যুদের নেই। তারা পাশবশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি নবজাগ্রত জাতির স্বাধীনতার আকাংক্ষাকে পদদলিত করে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখতে। আর সেই শাসন কায়েম রাখতে গিয়ে তারা নির্বিচারে নরহত্যা, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণের পাশবিকতার পথ অনুসরণ করেছে। নীতিবোধ, মনুষ্যত্ব, মানবিক ন্যায়বিচার সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে তারা দস্যু ও তস্করের নির্লজ্জ বর্বরতার ভূমিকায় নেমেছে- যেখানে তারা বন্যপশুর মতোই আদিম, হিংস্র ও নৃশংস। তাদের কাছে ন্যায়নীতি, সুবিচার, যুক্তি কিংবা মনুষ্যত্বের কোনো মূল্য নেই। নিষ্ঠুরতায় তারা বন্যজন্তুর মতোই অন্ধ, বর্বরতার তারা মধ্যযুগীয় হার্মাদ দস্যুদের মতোই হিংস্র ভয়ংকর।
বিপরীত দিকে বাংলাদেশের তরুণ যারা যুদ্ধ করছেন, তাদের সংগ্রাম নিজেদের মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রাম, মায়ের লজ্জা, বোনের অপমান, পিতার অমর্যাদার প্রতিশোধ গ্রহণের সংগ্রাম। তাদের রক্তে মায়ের বোনের ভায়ের রক্তের প্রতিজ্ঞা জড়িত। তাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঐ হানাদার বর্বর দস্যুরা বন্দী পশুর মতোই অসহায়, দুর্বল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয়-পতাকা। বাংলাদেশে উড়ছে স্বাধীনতার বিজয়-পতাকা, সেই সঙ্গে বিশ্বমানবতার মনের ভূগোলে অর্জিত হচ্ছে তাদের জন্যে সমর্থন ও শুভেচ্ছার রক্তকুসুম। পৃথিবীর দিকে দিকে উড়ছে তারই উজ্জ্বল মানবিক পতাকা। তাই ওদের যেখানে শেষ; আমাদের সেখানে শুরু।
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’ লিখেছেন, সামরিক ও রাজাকার বাহিনীর ক্রমাগত অত্যাচার বাংলাদেশের মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতে পারিনি। বরং অত্যাচার যতই বাড়ছে, বাংলাদেশের জাগ্রত জনতার মনে প্রতিশোধের স্পৃহা ততই প্রবল হচ্ছে। ঐ সাপ্তাহিকের বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নো দ্যা বোরচাগ্রাফ বলেছেন, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর এখন মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ প্রতিশোধ চায়। ‘শিকাগো নান টাইমসের’ সহযোগী সম্পাদক মি. রবার্ট ই, কেনেডি বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন নীতি তার কাছে হতবুদ্ধিকর। মার্কিন প্রেসিডেণ্ট সমস্যাটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী নন বলেও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। মি. কেনেডি স্বীকার করেছেন যে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য আসন্ন এবং তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন। বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধেও বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়। মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইমস এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের একটি দীর্ঘ বিবরণী প্রকাশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- পাকিস্তান একটি ডুবন্ত কুকুর। তার মাথা জলের নিচে ঠেসে ধরার কোনো প্রয়োজন নেই ভারতের।