পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

20| বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড শুধু মানুষ নয়, আমাদের অতি মেহনতে-গড়া শহর- সবুজের ভাঁড়ার ঘর আমাদের গ্রাম-যেখানে ছোটখাট সুখ-দুঃখ নিয়ে হাসিকান্নায় দিন কাটত- পরম শান্তির নিবাস আমাদের বহু গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে আওয়াজ মানুষের গোঙানি- রমণীর আর্তনাদ। বেঁচে যাওয়াটা এদেশে দৈবী ব্যাপার। ছোট ছেলেমেয়ে, এমন দৈবীভাবেই যারা বেঁচে গেছে, আজ তাদের মুখে স্বাভাবিক হাসি নেই। কান্না ভুলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল চেয়ে আছে সেই রাস্তার দিকে যে-পথে ঘরবাড়ি তছনছ করার পর বুটপরা খাকী লেবাস জানোয়ারেরা কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছে। এরা কেউ বাংলার বাসিন্দা নয়। বাংলাদেশের দুঃখ-আনন্দের শরীক তারা কী করে হবে? লুটতরাজের মালে পকেট বোঝাই এইসব জানোয়ারদের কাছে কিন্তু আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিসের পরীক্ষা? তা আপনাদের জানা। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে এই মসিবৎ পার হতে হয়েছে। পরীক্ষাআমরা বাঙালীরা মুসলমান কি না। তাই চার-কলেমা পড়তে হয়েছে উদ্যত সঙ্গীন বা রাইফেলের মুখে। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! যে বাঙালীর তাগদ ও তাগিদের জোরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে বাঙালী নিজ প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানদের প্রতি প্রীতি-পরবশ পাকিস্তান চেয়েছিল, যে বাঙালী শাসনতন্ত্র পরিষদে লিয়াকত আলি প্রমুখ অবাঙালীদের বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, নেহয়েৎ বাঙালীসুলভ উদারতায় এবং নিজে সংখ্যালঘিষ্ঠ বা মাইনরিটি হয়েছিল শাসনতন্ত্র পরিষদে- সেই বাঙালীকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে ও হচ্ছেঃ সে মুসলমান কি না। অদৃষ্টের পরিহাস বটে। পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বা হয়েছে কার কাছে? যে পাঞ্জাবী সৈন্য লুটতরাজ করে, নিরীহ নিরস্ত্রকে হত্যা-খুন করে, জুলুমের চাকা নির্দয় চালিয়ে যায়, বোনকে ভাইয়ের সামনে বলাৎকার করে- এমন জন্তুর কাছে। পশু ইসলামের ফর্মাবরদার। আর আমি আমার ভালমানুষিয়ানা এবং উদারতা নিয়ে মুসলমান নই। অদৃষ্টের পরিহাস বটে। ভাইবোনেরা আমার, আমাদের ভালুমানুষিয়ানার দাম দিচ্ছি। বড় চড়া দাম। রক্ত অশ্র অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা প্রাণের বিনিময়ে- বড় চড়া দাম। অথচ বাংলাদেশের পাটচাষী তার ফসলের দাম পায় না। রোদেবৃষ্টিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর তাদের আবাস জীর্ণ কুঁড়েঘর। ভরপেটে দু’বেলা অন্ন তাদের কাছে স্বপ্ন। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবে না, যেহেতু কুলকিনারা অসম্ভব। সেই পাটে আদমজী ইস্পাহানীরা শুধু ধুনকুবের হয় না, ঐ ফসলজাত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা অস্ত্রে সজ্জিত হয় পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী। সেই অস্ত্র আজ আমাদের বুকে বিধছে। ভালমানুষিয়ানার দাম এইভাবে দিতে হয় কি না? কেউ কোথায় দিয়েছে? পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভালমানুষিয়ানা ও সরলতার সুযোগ নিয়েছিল। আজও তার কামাই নেই। পূর্বে আমাদের তারা বাঙালী হতে দেয়নি। মুসলমান বানানোর চেষ্টা নিয়েছে। এর উপর ফিরিস্তি আজ দেয়া সম্ভব নয়। আপনারা জানেন। মিসর, ইরান, তুরানে মুসলমান থাকতে পারে- মিশরী ইরানী তুরানী হয়েও। কিন্তু আপনি আমি বাঙালী হলে আর মুসলমন থাকতে পারি না। শোষণের চাকা সদা সচল রাখতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তাঁবেদার কিছু দেশী দালাল সব সময় এই দাগাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এমন কি আমাদের প্রতি কটাক্ষ করতে জিন্না সাহেবের পর্যন্ত এতটুকু বাধেনি। ওদরে জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। তাই তো হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু মাদারীর পুরাতন খেল চালু করতে ওদের কসুর নেই। পচিশে মার্চের রাত থেকে নেকড়ের মত যখন বাংলদেশের নিরীহ-নিরস্ত্রের উপর পোষা জন্তুরা ঝাঁপিয়ে