পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

212 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড ছবিগুলো দেখা হলে চলে এলাম আমি। পথে এক পা দু’পা করে হাটছিলাম, আর ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, সে অনেক কথা! হয়তো বন্ধুটি ক্যাপশন লিখবে ছবিগুলোর। এরপর তার এ্যালবামে সাজিয়ে রাখবে একে একে। বাংলাদেশ শত্রমুক্ত হবে। এরপর চলে যাবে এক বছর, দু’বছর- দশ বছর, বিশ্ব বছর বা আরও কয়েক বছর। কিন্তু ছবিগুলো? এগুলো ঠিকই থেকে যাবে এ্যালবামে। এরপর হঠাৎ একদিন এ্যালবামটা পড়বে বন্ধুটির কোন এক ভবিষ্যৎ বংশধরের হাতে। সে ছবিগুলো দেখে যাবে, তা থেকে শিক্ষা নেনে- তরে ঠিক ছবি হিসেবে নয়, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হিসেবে। (জাহাঙ্গীর আলম রচিত) মুক্তি সংগ্রামে মায়ের প্রেরণা ৪ নভেম্বর, ১৯৭১ মুক্তাঞ্চলেই মায়েদের সভা ডাকা হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলছিল সভার কাজ। একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গেলেন। সারাদিনের খাটুনিতে মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে চোখ বুজেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ পায়ের শব্দে তাকিয়ে দেখি আনুর মা ভাবী এসে দাঁড়িয়েছেন আমার টেবিলের কাছে। আমাকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসতে দেখে বললেন, “মাথাটা ধইরছে বুঝি, টিইপ্যা দিমু|” হেসে বল্লাম, “না, তেমন কিছু না, ও এমনি সেরে যাবে।” “না না সরম কইর না, খাডনী পইড়ছে ধরব না ক্যান।” আনুর মা ভাবী সত্যি সত্যি হাত লাগাতে আসছে দেখে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম, “তেমন কিছু মাথা ধরেনি। সভা শেষ হবার পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। যাক ওসব। আচ্ছা ভাবী সভা তো হলো। সবাইকে বললাম এবং সবাই স্বীকার করলেন প্রত্যেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের জন্য কাপড়, জামা , কাঁথা সেলাই করে দেবেনে। সত্যি, হবে তো?” “অইব না মানে? আইজ থাইক্যা হগলে ল্যাইগা যাইব৷ মুক্তিবাহিনীর ছাওয়ালগুলা আমাগো ছাওয়াল না? ছাওয়ালগো বাঁচান আমাগো ফরজ না?” একটা গর্বিত দীপ্তিতে আনুর মা ভাবীর মুখখানি ঝলমল করে উঠল। মাতৃত্ব ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে। বিস্মিত হলাম এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলার তেজস্বিতায়, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদে। একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাবী, আনুর কোন সংবাদ পেয়েছ?” আনোয়ার ওরফে আনু ভাবীর একমাত্র ছেলে। আর একটি ছেলে ছিলো, নাম হাবিব। কারখানায় কাজ করতো। এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে দু’বছর আগে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে, যার যার স্বামীর বাড়িতে থাকে। আনুই ছিল ভাবীর কাছে। বোশেখের শেষের দিকে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো একটা লক্ষ্মী মেয়ের সাথে। সে বিয়ে আর হতে পারেনি। এরই মধ্যে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশের উপর চালিয়েছে নারকীয় আক্রমণ। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। যে মেয়েটির সথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে খুনী পাকসেনা। মেয়েটির কোন হদিস নেই। আনু তার মাকে নিয়ে চলে এসেছে মুক্তাঞ্চলে, তার মামার বাড়িতে। এখানে এসে আনু শুধু ছটফট করতো আর বলতো, “মা , আমাকেও কিছু করতে হবে।” ভাবী প্রথমে ছয় পেতেন, আনুকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন- “আমাকে দেখাই তোর এখন ফরজ কাম।” আনুও বেশীকিছু কথা বাড়াতো না।