পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

215 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মেয়েদের জীবন যে কত সমস্যার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে সেকথা ভেবে আমরা বেদনায় অস্থির হই। সেখানে খাদ্যভাব, অর্থাভাব এবং চিকিৎসার নিদারুণ অভাব ছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। দখলীকৃত এলাকায় যে-কোন মুহুর্তে যে কোন স্থানে পশ্চিম পাকের পশুসেনারা অথবা রাজাকার বাহিনীর গুণ্ডারা যে-কোন মেয়েকে তাদের পাশবিক আনন্দের শিকারে পরিণত করতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, দখলীকৃত এলাকায় এই সংকটের মুখে বাস করেও আমাদের নারী সমাজ সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। দখলীকৃত অঞ্চলের যে গ্রামে মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা আশ্রয় গ্রহণ করেন সেই গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে তাঁদের জন্য রুটি প্রস্তুত করতে বসেন, ভাত রান্না করেন এবং পরম উৎসাহ সহকারে খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা এই যে, গ্রামের মেয়েরা মুক্তবাহিনীর সেননীদের জন্য খাবার তৈরি করে যে কি এক গভীর তৃপ্তি অনুভব করে তার সীমা নেই। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি গ্রাম ও শহরের সর্বত্র দখলীকৃত বাংলাদেশের মেয়েরা কি অসীম প্রতীক্ষায় দিন গুণছে- কখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে বিজয়ের দিন আসবে আর বাংলাদেশ এই পশুদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করবে। এই আন্তরিক শুভেচ্ছার মূল্য যুদ্ধের দিনে কম নয়। আমরা মনে করি, মহিলারা মুক্তিবাহিনীর সেনানীদের খাবার প্রস্তুত করে, তাদের উৎসাহ প্রদান করে যেভাবে সাহয্য করছে তারও অপর নাম সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মহিলা সমাজও তাই কৃতিত্বের দাবীদার। কিন্ত বাংলাদেশের মহিলারা কৃতিত্ব চান না- পার্থিব কোন কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের মহিলারা কাজ করেন না। সন্তানের মুখে, ভাইয়ের মুখে, স্বামীর মুখে, পিতার মুখে তাঁরা যদি দেখতে পান অমলিন হাসি, তবে সব কষ্ট, সব ত্যাগকে তাঁরা সার্থক মনে করেন। দেশজুড়ে এই হাসিমুখ যদি তাঁরা দেখতে পান তবে তাই হবে তাঁদের সবচেয়ে বড় পাওয়া, সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আরো একটি উপায়ে বাংলাদেশের মহিলারা এই সংগ্রামে সাহায্য করতে চলেছেন। মায়েরা সন্তানকে বোনেরা ভাইকে এবং স্ত্রীরা স্বামীকে বার বার তাগিদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য প্রেরণ করছেন। রাজশাহী জেলার উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামে এমনি একজন মহীয়সী মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তার একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটির বয়স বাইশ বছর। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ছেলেটির পিতা যদিও দেশপ্রেমিক-তবুও একমাত্র ছেলের প্রতি অসীম দুর্বলতা। বস্তুত তিনি ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু মা বলেছেন, না-আজ যখন মা-বোনের ইজ্জত ভুলুষ্ঠিত করেছে পাক-সেনারা তখন আমার ছেলেকেই সেই ইজ্জত রক্ষার্থে প্রথম যুদ্ধে যেতে হবে। ছেলেটিকে হাসিমুখে তিনি যুদ্ধে পাঠিয়ে এখন পবিত্র প্রতীক্ষায় দিন গুণছেন। তাঁর ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে আবার তাঁর কোলে ফিরে যাবে। তাঁর মনে দুঃখ নেই, কোন সংশয় নেই। সেই মহীয়সী মায়ের কথা মনে পড়ে শ্রদ্ধার আমার মাথা নত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ এমনি মায়ের পবিত্র মুখ আমরা দেখতে পাব। সেই মুখগুলো শুধু পবিত্র নয়- যেন বঙ্গজননীর মুখচ্ছবির মতই সে মুখগুলো সোনালী অরুণাভায় সমুজ্জ্বল। আর তাঁদের সেই সংগ্রামের মূল্যও আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অপরিসীম মূল্যে স্বাক্ষরিত। (নূরজাহান মযহার রচিত)