পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

250 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সর্বপ্রথম এই ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যতশীঘ্র সম্ভব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মেঘনা নদীর ওপর ভৈরব রেলব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মতো বড়ো বড়ো সেতুগুলোর ব্যবস্থাধীনেই তুরান্বিত হবে- কিন্তু বাড়ি পাশের, গ্রাম-গঞ্জের ছোটখাট পুলগুলো গ্রামীণ স্থানীয় চেষ্টায় মেরামত করা অসম্ভব কিছু নয়। এ ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে সাধারণ মানুষকেই। আপনার বাড়ির পাশের যে স্কুলটি কিম্বা আপনার বাড়ির পাশের মসজিদটি, যা কিছুদিন আগে হানাদার বাহিনীর কামানের গোলা বা বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আপনাদের দায়িত্ব নিজেদের প্রচেষ্টায় তার প্রয়োজনীয় পুনঃনির্মাণ। সরকারকে ছোটখাটাে পুনর্গঠনের দায়িত্বের দিকে টেনে না এনে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সরকারী প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাতে দেয়া। আজকে অর্থনৈতিকও সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান প্রভৃতি যে মহান দায়িত্ব সরকারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সমবেতভাবেই সেই দায়িত্ব পালনে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘদিন শত্রকবলিত বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদন অসম্ভব রকম হাস পাওয়ায় এবং বহিঃবিশ্বের সংগে যোগাযোগহীন হয়ে পড়ায় গ্রামে গ্রামে তেল, কেরোসিন, লবণ, সাবান, কাপড়, ঔষধপত্র প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। যোগাযোগের অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কালোবাজারী-মুনাফাখোর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়াবে। স্থানীয়ভাবেই গ্রামে গ্রামে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, অসামরিক প্রশাসন গ্রামে গ্রামে চালু হবার সময় এসে গেছে। সুযোগসন্ধানী যারা সময়ের সুযোগ নিতে চাইবে- দেশদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তিই তাদের প্রাপ্য হবে। আগামী শুভ নববর্ষের পদার্পণের সংগে সংগেই পূর্ণ উদ্যমে শুরু হবে বাংলাদেশ সরকারের তথা বাংলাদেশবাসীর পবিত্র দায়িত্ব- শরণার্থীদের পুনর্বাসন। এই পবিত্র মানবিক দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সাহায্য, সহানুভূতি ও সশ্রম আত্মত্যাগ অপরিহার্য। এ দায়িত্ব সরকারের নয়- এই পুনর্বাসনের নৈতিক ও মানসিক দায়িত্ব আপনার আমার সকলের। হানাদার বাহিনীর প্ররোচনায় যে সমস্ত দালাল অনেক ভাবে অপরের সম্পত্তি, বাড়িঘর ও অস্থাবর মালামাল নিজেদের দখলে রেখেছিল- সরকারী হস্তক্ষেপের পূর্বেই সবকিছু ফিরিয়ে দিয়ে তাদের কর্তব্য হবে পুনর্বাসনের কাজকে তুরান্বিত করা। অবৈধভাবে অপরের সম্পদ ভোগ-দখলের যে কোন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আপনার বাড়ির পাশেই তার নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে দীর্ঘ দশ মাসের অনিশ্চিত জীপনযাপনের পর আজ শরণার্থীদের দিকে বন্ধুত্বের কোমল হাতকেই প্রসারিত করা। ভাই, বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ পরস্পরের সহযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। জনসাধারণের মধ্যে এই শুভবুদ্ধির প্রসার ঘটাতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ঘৃণা নয়, প্রতিবেশী বলে বুকে টেনে নিতে হবে পরস্পরকে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টার সফলতা জনসাধারণের সহযোগিতা নির্ভর। যাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে, তাদের জন্য ঘর তুলতে হবে- প্রয়োজনবোধে অর্থ, প্রয়োজনীয় আসবাব দিয়ে সাহায্য করতে হবে আমাদের যে অশুভ শক্তি একদিন তার অসহনীয় বর্বরতা দিয়ে এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করেছিলঅনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা সেই শক্তিকে পরাজিত করেছি। সেই ত্যাগের মহান আদর্শ, সেই সহযোগিতার ঐতিহ্যই বাংলাদেশের প্রতিটি পুনর্গঠনে আমাদের সরকারের হাতকে শক্তিশালী করুক, ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই আমাদের সরকারের হাতকে শক্তিশালী করুক। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই আমাদের আকাংক্ষিত সোনার বাংলাদেশ নতুন আলোয় স্নাত হবে। (নির্মলেন্দু গুণ রচিত)