পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

259 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সুবেদার মেজর ৩৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের একজন লোক। কয়েক বছর আগে বাঙালীর গৌরব বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢুকেছিলেন একজন সৈনিক হিসাবে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ছিলেন যশোর ক্যান্টমেন্টে। তারপর থেকে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছেন দখলকার সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানেন না, তাঁর পরিবারের কে আজ বেঁচে আছে আর কে বেঁচে নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন “পরাধীন জাতি হিসাবে বাঙালীদের বেঁচে থেকেই বা লাভ কি? পশ্চিমারা যেভাবে জাতি হিসাবে আমাদের অপমান করেছে, সর্বনাশ করেছে- তার প্রতিশোধ নিতেই হবে। আর সব কথার সেরা কথা বাংলাদেশকে শত্রকবলমুক্ত করতেই হবে। তারপর বাপ-ভাই-এর অভাব হবে না বাংলাদেশে।” অবাক হয়ে ভাবলেন এই আধশিক্ষিত লোকটির কথা। কি অসীম দৃঢ়তা! কি গভীর আত্মপ্রত্যয় বিরাজ করছে তার মাঝে! বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাঙালীর অপমানের প্রতিশোধই আজ তার কাছে বড়। নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্রদের বেঁচে থাকা না থাকার প্রশ্নটি আজ তার কাছে গৌণ। এতদিন পরে বুঝতে পারলাম কি করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে মাত্র দুই কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের অন্ততঃ ৫/৭ গুণ শত্রসৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও যুদ্ধ করতে করতে পথ করে নিতে পেয়েছিলেন। সেদিন তাদের পাঞ্জাবী-অধিকর্তা লেঃ কর্নেল বেঈমানী করেছিল। ষড়যন্ত্র করে সন্ধ্যার সময় অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু এরা বাঙালীর জাতশত্রদের হুকুম মোতাবেক আত্মসমর্পণ করেনি। অন্যান্য বাঙালী অফিসারদের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধ করেছে। একজনের প্রাণের বদলে ১০ জনের প্রাণ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে। সুবেদার মেজরের কাছে শুনলাম ক্যাপ্টেনের পশু-শিকারে যাওয়ার কাহিনী। তিনি বললেন, ‘একটু আগেই খবর এসেছে ৪০-৫০ জন খানসেনা এসে আস্তানা গেড়েছে। গত রাতেও তারা নাকি ওখানে ছিল। আজ রাতে ওদেরকে দলবলে খতম করতে হবে। স্থানটাও এখান থেকে বেশ দূরে। তাই ক্যাপ্টেন জন পনেরো মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এখনই রওয়ানা হতে যাচ্ছেন।” বললাম, ৪০-৫০ জন সুদক্ষ শত্রসৈন্যের মোকাবেলায় আমাদের ত আরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা যাওয়া দরকার।’ তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘না, না, তা মোটেই নয়। আমাদের ১৫ জনই ওদের ৫০ জনের মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। ইনশাআল্লাহ, ঐ ১৫ জনের হাতেই ওদের অন্ততঃ ৩০ জন খতম হবে এবং অন্যরা কুকুরের মত পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করবে।’ কথা প্রসঙ্গে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম উভয় পক্ষের হতাহতের তুলনামূলক হার। তিনি একটা রেকর্ড বের করে বললেনঃ হতাহতের হার হচ্ছে ১:৫০- অর্থাৎ গড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার বদলে ৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে। আমি বললাম, এমনটা কি করে সম্ভব? যুদ্ধে দু'পক্ষের হতাহতের এমনতর অনুপাতের কথা ত কোনদিন শুনিনি।’ জবাবে তিনি বললেনঃ “আমরাও আগে শুনিনি। কিন্তু এখন নিজের চোখে দেখছি। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন? আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ওদের খতম করা। আর ওদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণে বাঁচা। তাই, প্রাণের বাঁচার তাগিদে ওরা এখন আর আমাদের সাথে যুদ্ধই করতে পারছে না, আর কোনদিন পারবেও नीI'.........